• প্রথম পাতা
  • আরবী সাহিত্যে শাইখুল হাদিস সেমিনার
    • হযরত পাহাড়পুরী হুজুর দা: বা:
    • শাইখুল হাদিস আল্লামা আশরাফ আলী
    • মুফতি আব্দুল মালেক দা: বা:
    • মাওলানা আব্দুল মতিন বিন হুসাইন
    • মুফতি মাহফুজুল হক দা:বা:
    • মাওলানা শহিদুল্লাহ ফজলুল বারী ও উবায়দুর র
    • মাওলানা আব্দুল জব্বার দা: বা:
    • ড: শামসুল হক সিদ্দিকি দা:বা:
    • মাওলানা যায়নুল আবেদীন
  • শাইখুল হাদিস কনফারেন্স
    • উলামা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য প্রö
    • উলামা ওরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা-২
    • উলামা ওরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা-৩
    • হাফেজ উমর রহ:
    • শাইখূল হাদিস মামুনুল হকের ভাষণ
    • তারানা- সাঈদ আহমাদ
  • রাহমানিয়া ছাত্র কাফেলা স্মৃতি আলোচনা
    • স্মৃতি আলোচনায় মাওলানা মামুনুল হক
    • স্মৃতি আলোচনায় মুফতি সাঈদ আহমাদ
  • জীবনের বাঁকে বাঁকে
    • আব্বার শাসন ও সযত্ন অনুশীলন
    • আমার আম্মার কথা
    • লেখাপড়ার সুচনা
    • হযরত শামছুল হক ফরিদপুরীর সাহচার্য আমার জী
    • আমার তালিম ও তরবিয়াতে হযরত ফরিদপুরির দরদ ও &#
    • হযরত রফিক আহমাদ কাশ্মিরী রহ. এর কথা
    • হাদিসে রাসুল সা. এর প্রথম পরশ
    • দাড়িয়ে তব দুয়ার মাঝে
    • অধমের মাথায় হযরত থানভীর পাগড়ি
    • হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.
    • হুজুরের স্নেহের একটি নমুনা
  • সরাসরি সম্প্রচার
  • প্রধান কলাম সমূহ
    • বিদায় বাংলার শাইখুল হাদিস
    • উলামায়ে দেওবন্দের পতাকাবাহী
    • এক আল্লাহ ছাড়া কারো ভয় ছিল না
    • শাইখুল হাদিসকে যেমন দেখেছি
    • শাইখুল হাদিস রহ. স্মরণে
    • আমার জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক
    • হেফাজতে দ্বীনের জন্য শায়েখের আদর্শ গ্রহন 
    • শাইখুল হাদিসের স্মৃতিকথা, তাযকিরাতুল আজিö
    • শাইখুল হাদিস অনুদিত বুখারী শরীফ
    • জীবনের বেলাভূমিতে প্রিয়তম শাইখুল হাদিস
    • নবী প্রেমের কবি
  • জীবনউপলদ্ধি
    • তার জীবন আমাদের উপমা
    • ঘরে বাইরে শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক র
    • আদর্শ শিক্ষক যার শ্রেষ্ঠ পরিচয়
    • শাইখুল হাদিসের জীবনী পাঠ্য করা হোক
    • মওতুল আলেমি মওতুল আলমি
    • আজ আমি এতিম
    • অনন্য শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক
    • তিনি আমাদের বুখারীর ইমাম
    • আললামা
    • গন্তব্যে আমৃত্যু অবিচল
    • তিনি কোটি মানুষের প্রেরনা
    • দ্বীনের সফল মহানায়ক
  • গবেষনা
    • হকের উপর অটল এক ব্যক্তিত্ব
    • অসাধারন গুনাবলীর অপূর্ব সমাহার
    • হাদিস চর্চায় কালজয়ী অবদান
    • আমার দেখা শাইখুল হাদিস
    • তিনি কেন অসাধারণ
    • ঈমানদীপ্ত এক বীরের গল্প
    • রহমানিয়া ও শাইখুল হাদিস রহ.
    • আপনি ঘুমাতে পারেন না
    • রাজনীতিবিদ শাইখুল হাদিস
    • বাবরী মসজিদ লংমার্চ
  • অনুভূতি
    • আমার অনুভূতি
    • দীনের দরদী খাদেম
    • তার সাথে আমার জীবনাচার
    • শাইখুল হাদিসকে যেমন দেখেছি
    • হাদিসের দিকপাল
    • মহানুভবতার উজ্জল দৃষ্টান্ত
    • ইলম ও আমলের প্রানময় বটবৃক্ষ
    • স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
    • শাইখুল কুরআন
    • আদর সোহাগে গড়েছেন এক আদর্শ পরিবার
    • যে রত্ন আজ হারিয়ে খুজিঁ
  • স্মৃতি আলোচনা
    • প্রিয় রাহবারের শবযাত্রার মিছিলে ৩০ ঘন্টা
    • কতো স্মৃতি কতো কথা
    • সুযোগ পেলেই তার কপালে চুমু খেতাম
    • স্মৃতির পাতায় শাইখুল হাদিস
    • যার জিকিরে গুন্ঞ্জরিত মাদরাসা
    • শাইখুল হাদিস জিন্দাবাদ নয়
    • স্মৃতিগুলো জেগে থাকে মনে
    • স্মৃতি ও স্বপ্ন
    • স্মৃতিতে শাইখুল হাদিস
    • স্মৃতিগুলো এলোমেলো
    • মনের মুকুরে
    • সবই আছে শুধু নানাজি নেই
    • স্মৃতির পাতায় শাইখুল হাদিস
  • একান্ত সাক্ষাতকারে শাইখুল হাদিস
  • শাইখুল হাদিসের বৈচিত্রময় জীবন-সাধনা
    • বংশ ও পূর্ব পুরুষ
    • জন্ম ও শৈশব কাল
    • শিক্ষা জীবন
    • উল্লেখযোগ্য শিক্ষকবৃন্দ
    • শিক্ষকতা
    • রচনা ও সংকলন
  • স্মৃতি তারানা
    • তুমি সত্য ন্যায়ের বাতি
    • এতিম হলো দেশ
    • তার বিদায়ে কেঁদেছে মানুষ
  • ছবি গ্যালারী

জীবন সায়াহ্নে শাইখুল হাদীস রহ.ছোট ছোট অসুস্থতা

কর্ম জীবনের দীর্ঘ ও ক্লান্তিহীন অভিযাত্রায় শেষ জীবনে আব্বাজান হযরত শাইখ রহ. ধীরে ধীরে অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে থাকেন। বার্ধক্যই ছিল তার মূল রোগ। ফার্সিতে প্রবাদ আছেÑ ‘একপীরি সদ বিমারী’  ‘এক বার্ধক্যই শত রকম রোগ।’ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেছেনÑ 
‘আর আমি যাকে অধিক বয়স দেই সৃষ্টিগতভাবে অবনতি ঘটাই।’ সূরা ইয়াসিন
জীবনের পড়ন্তকালে হযরত শাইখের যে সকল শারিরিক দুর্বলতা বা অসুস্থতা ছিল তার মধ্যে একটি ছিল শ্রবণশক্তি সামান্য লোপ পাওয়া। মূলত দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাম কানে ‘তব্ধ’ লেগেছিল। সেটা আশির দশকের শেষ দিকের কথা। নিজস্ব প্রাইভেট যান বাহনের ব্যবস্থা তখনও হয়নি। রিক্সা বা গণ পরিবহন বাসই ছিল হযরতের যাতায়াত মাধ্যম। ঐ সময়ে এক দিন মোহাম্মদপুর মাদরাসা থেকে বাসায় যাওয়ার পথে সাইন্সল্যাবরেটরি থেকে আজিমপুরগামী একটি বাসে দ্রুত ওঠার সময় দরজায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ছিলেন। এতে ‘স্তব্ধ’ লেগে বাম কানের শ্রবণশক্তি কিছটা হ্রাস পেয়েছিল। চিকিৎসায় কিছুটা উন্নতি হলেও পূর্ণ আরোগ্য হয়নি। তা ছাড়া অপর কানের সুস্থতা পূর্ণ থাকায় এটা তেমন উদ্বেগের কারণ হয়নি। বার্ধক্যের কারণে উভয় চোখে ছানি অপারেশন করে লেন্স লাগানো ছিল। এ ছাড়া জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হযরতের দৃষ্টিশক্তি শুধু সুস্থই না বরং বেশ প্রখর ছিল বলা যায়। 
ধীরে ধীরে দাঁতগুলো সব পরে গিয়েছিল। ফলে আলগা দাঁত ব্যবহার করেছেন প্রায় ১৫/২০ বছর।
বংশগতভাবে হাঁটুতে বাতের ব্যথা ছিল। শেষ জীবনে সেই সমস্যার প্রকোপ বাড়তে থাকলে পর্যায়ক্রমে লাঠিতে ভর করে এবং এক পর্যায়ে হুইল চেয়ারে করে চলতে হয়েছে। শারীরিক রোগ বলতে শাইখের জীবনে এটাই ছল সবচেয়ে দীর্ঘকালীন রোগ।
স্মৃতির বিস্মৃতি
এ সকল ছোট ছোট উপসর্গের পরে ধীরে ধীরে শাইখ রহ.-এর স্মৃতি লোপ পেতে থাকে। শুনেছি আসল দাঁত দিয়ে চিবাতে না পারায় আহার থেকে মস্তিস্কে পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি সরবারাহ হয়নি।  সেই সাথে অবিশ্রান্ত মেধার পরিশ্রম করেছেন একটানা নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত।  বিরতিহীন এই মেধার শ্রম দেমাগি দুর্বলতার কারণ হয়ে থাকতে পারে।  ছাত্র জীবনের শেষ দিকেও অত্যধিক পরিশ্রম ও কম ঘুমানোর ফলে একবার দেমাগি দুর্বলতা তথা মস্তিস্কে শুষ্কতা দেখা দিয়ে ছিল, আব্বাজান হযরত শাইখের। সেই থেকে আজীবন মস্তিস্ক ও দেমাগের সুস্থতার জন্য দেমাগি বলকারক হেকিমি ওষুধ সেবন করতেন। নিজের শারীরিক ও মস্তিস্কের সুস্থতার প্রতি যতœশীল ছিলেন। এই উসিলায় আল্লাহ রব্বুল আলামিন দীর্ঘ জীবন পর্যন্ত হযরতকে কর্মক্ষম রেখেছেন এবং তার দ্বারা দীনের বহুমুখী খেদমত আঞ্জাম পেয়েছে।   জপি শুধু প্রিয়, তব নাম তা ছাড়া কুদরতের ফায়সালাও হয়তো এমনই ছিল যে, কর্মের ময়দানে দূরন্ত ছুটে চলা এই কর্মবীর জীবন সায়াহ্নে এসে সকল মাখলুকের কথা বিস্মৃত হয়ে যাক। স্থির যয়ে যাক তার সরব পদচারণা। জীবন সংগ্রামে বিজয় ও সফলতার ধাপগুলো পেরিয়ে আসার পর যাপন করুক একখণ্ড অবসর জীবন। যখন তার জীবন জুড়ে থাকবে শুধ এক সত্ত্বা। ধ্যানে-জ্ঞানে, মনে-মস্তিস্কে গোটা অস্তিত্ব জুড়ে থাকবে সেই প্রিয়তমের অনুভব, যার দীনের  তরে উৎসর্গিত ছিল তার কর্মজীবন। ‘খালওয়াত দর আঞ্জুমান’ ‘জন সমাগমের মাঝেও প্রিয়তমের একান্ত সান্নিধ্যের’ মিলন-সুধা পান করে শান্ত হোক তৃষ্ণার্ত আত্মা। Ñ ‘ফাসাব্বিহ বিহামদি রাব্বিকা ওয়াসতাগফিরহু’
‘আপনার প্রভুর প্রশংসাগাথা পবিত্রতা বলুন আর ইস্তেগফারের মাধ্যমে তার নিকট সমর্পিত হোন।’Ñএর সৌভাগ্য লাভ হোক তার খোশ নসিব। জীবনের শেষ প্রায় দুই বছর স্ত্রী, পুত্র-পরিজন সকলের স্মৃতিই বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। ব্যতিক্রম ছিল শুধু একটি নাম। ‘আল্লাহ’! শেষ মুহূর্ত অবধি অস্ফুট স্বরে জারি ছিল সেই প্রিয় আল্লাহ আল্লাহ জপ।
থমকে গেল তব পথ চলা
১৪৩১ হিজরি রমজানের পূর্ব পর্যন্ত কখনো কখনো মাদরাসায় যাতায়াত ছিল। সেই রমজানেও দু-একবার বাসার বাইরে গিয়েছেন নিজের ইচ্ছায়। রমজানের শেষ দিক থেকে দুর্বলতা বাড়তে থাকলে ছোট্ট ঘরের চার দেয়ালই হয়ে যায় তার জীবন জগত। এরপরও তিনি বেরিয়েছেন বাসার চার দেয়ালের বাইরে। তবে সেটা স্বেচ্ছায় নয়; অন্যদের ইচ্ছায়। প্রধানত  চিকিৎসার প্রয়োজনে হযরতকে বাসার বাইরে নিতে হয়েছে। এ ছাড়া তার প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান জামিয়া রাহমানিয়ায় নেয়া হয়েছে কয়েক বার। তন্মধ্যে একবার জামিয়ার ছাত্রদের সাক্ষাতের জন্যে। আর তিন বার তার পরিবারের তিনজনের বিয়ের আকদ উপলক্ষ্যে। সর্বকনিষ্ট সন্তান মাসরুরুল হকের বিয়ে, তৃতীয়া কন্যার ঘরের (দীর্ঘ দিনের মদিনা নিবাসিনী)  দৌহিত্রীর বিয়ে এবং সর্বশেষ তার বড় ছেলের ঘরের দৌহিত্র নাঈমুল হকের বিয়ে উপলক্ষ্যে হযরতের আগমন ঘটে তার প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠানে। ১৮ এপ্রিল নাঈমের বিয়ে উপলক্ষ্যে এই আগমনই ছিল প্রাণপ্রিয় জামিয়া রাহমানিয়ায় হযরতের শেষ আগমন।-এরপরও অবশ্য ৮ই আগস্ট দিবাগত রাত্রে এসেছেন প্রাণপ্রিয় জামিয়ার প্রিয় প্রাঙ্গণে তবে সেটা ছিল শত সহস্র ভক্তকুলের চোখের অশ্র“ভেজা সাদাসুভ্র কাফনে জড়ানো শাইখুল হাদীসের আগমন।
 শেষ জীবনের খাদ্যাভ্যাস
এই বিশেষ প্রয়োজনে বাসার বাইরে নেয়া ছাড়া আব্বাজান হযরত শাইখের সময় কাটত শান্ত-সুবোধ শিশুর মতো বিছানায় শুয়ে শুয়ে। খাবারের সময় উঠিয়ে বসানো হতো। বসিয়েই খাবার খাওয়ানো ছিল ডাক্তারি নির্দেশনা। এই দীর্ঘ দুই বছর সাধারণত তরল খাবারই ছিল হযরতের খাদ্য। চামচে করে খাবার তুলে দেয়া হতো মুখে, আর শিশুর মতো খবার খেতেন হযরত। এমনিতেই সারা জীবন মিষ্টি খাবার খেতে হযরত পছন্দ করতেন। জীবনের এই পর্যায়ে এসে সে আকর্ষণ যেন বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। মিষ্টি ছাড়া কোনো খাবার মুখেই তুলতে চাইতেন না। সব্জি ও পুষ্টিকর উপদান দিয়ে নরম করে খিচুড়ি রান্না করে অতপর পর্যাপ্ত পরিমাণ মিষ্টি দই মিশিয়ে খাবার খাওয়ানো হতো। আবার বেশি করে দুধ ও মিষ্টি দিয়ে সাগুদানার ফিরনি রান্না করেও খাওয়ানো হতো। এছাড়া বাচ্চা মুরগির স্যুপ, ফলের নিংড়ানো রসসহ মৌসুমি ফল-ফলাদি নরম করে দিলে পর্যাপ্ত পরিমাণ খেতে পারতেন। আল্লাহর রহমতে সারা জীবনের মতো হজম শক্তি ভালোছিল। খাবার হজম হতে তেমন সমস্যা হতো না। ওষুধও তরল করে মিষ্টি মিশিয়ে সেবন করাতে হতো।
শরীরে দেখাদিল উপসর্গ  
স্বাভাবিক খাবার খেতে না পারা এবং শয্যাশায়ী হয়ে চলাফেরা এক রকম বন্ধ থাকায় শরীরে প্রোটিনের ঘাটতি হয়। এতে ইন্তেকালের ৬/৭ মাস আগে শরীরে চর্ম রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। শরীরে বিভিন্ন অঙ্গে চামড়ার মধ্যে পানির মতো জমাট বেধে ফোস্কা পড়ত। অতপর সেই ফোস্কা ফুটে গিয়ে দগদগে ক্ষত সৃষ্টি হতো। ক্ষতগুলো এতটাই প্রকট আকারের হতো যে, পরিবারের সদস্যদের জন্য  তা সহ্য করা সম্ভব হত না। কিন্তু হযরত শাইখ রহ. এই অবস্থাতেও যথেষ্ট শান্ত থাকতেন।    
হযরতের চিকিৎসা  এই সময়টায় চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী এ. করীমের নিকট চিকিৎসা চলতে ছিল। তিনি ‘এন্টিবায়োটিক’ দেয়ার ক্ষেত্রে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতেন। কারণ হযরতের বার্ধক্য ও শারীরিক দুর্বলতা জনিত কারণে বেশি পাওয়ারের এন্টিবায়োটিক প্রয়োগে জটিল পার্শ প্রতিক্রিয়ার আশংকা ছিল।  এই অবস্থায় ক্ষতস্থানে  পর্যাপ্ত মধু দিয়ে প্রলেপ দেয়া হতো। এতে শাইখ বেশ আরাম অনুভব করতেন।
শাইখের সার্বিক চিকিৎসা বাংলাদেশের খ্যাতনামা চিকিৎসাবিদ বারডেমের চেয়ারম্যান প্রফেসর এ.কে আজাদ চৌধুরীর পরামর্শে ও তার তত্ত্বাবধানেই চলতো। ড. আজাদ সাহেব হযরতের বড় জামাতা আমাদের বড় দুলাভাই প্রফেসর মাওলানা গিয়াসুদ্দীন সাহেবের সহপাঠী ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়ার পাশাপাশি হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর গুণমুগ্ধ ও একনিষ্ঠ ভক্ত। তাই তিনি অত্যধিক ভক্তি ও ভালোবাসা নিয়ে শাইখের চিকিৎসা করতেন এবং প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী ডাক্তারের নিকট রেফার করতেন। মাঝে মাঝে বাসায় এসে দেখে যেতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা দিতেন। চর্ম রোগের সমস্যা প্রকট হলে ড. আজাদ সাহেব বারডেমেরই ডাক্তার রেজা বিন জায়েদের কাছে রেফার করলেন।  ডা. রেজা বিন জায়েদের ব্যবস্থা পত্র অনুযায়ী চিকিৎসায় আল্লাহর রহমতে এই সমস্যা অনেকটাই লাঘব হয়ে যায়।
অসুস্থতার নতুন সমস্যা
চর্ম রোগের সমস্যা লাঘব হওয়ার অব্যাবহিত পরেই হযরতের শরীরে আরেক জটিল উপসর্গ দেখা দেয়। হাত-পাসহ শরীরে পানি জমে যায়। পেটে পানি জমে পেট শক্ত হয়ে থাকে। এতে খাবারের রুচিও অনেক কমে যায়। খাবার মুখেই দিতে চাননা।  মনে হলো শরীরে কেমন যেন অস্বস্থি বোধ করছেন। ফলে চিরচেনা সেই হাসি মুখটাও কেমন যেন মলিন হয়ে থাকে। দুই তিন দিন এই অবস্থা অব্যাহত থাকায় ড. আজাদ সাহেবের পরামর্শে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বারডেম হাসপাতালের ১২ তলার ৭নং কেবিনে ৫/৬ দিন চিকিৎসাধীন থাকেন। 
প্রাণবন্ত শাইখুল হাদীস
এই চিকিৎসায় অবস্থার বেশ উন্নতি ঘটলে হযরতকে বাসায় নিয়ে আসা হয়।  সুস্থ্য-সবল হাসি-খুশি শিশুর মতো কাটতে থাকে হযরতের দিন। শারীরিক অসুস্থতা ও উপসর্গ না থাকায় হযরত অনেক প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন। খাবারের রুচিও মাশাআল্লাহ অনেক বেড়ে যায়। যথেষ্ঠ পরিমাণ খাবার খেতে থাকেন। এমন কি অবস্থার এতোটাই উন্নতি হয় যে, নিজের হাতেও কিছু কিছু খাবার খেতে লাগেন।  (জুন মাসের শেষার্ধ এবং জুলাইয়ের প্রথমার্ধ) জুন, জুলাইয়ের এই সময়টায় হযরত শাইখ রহ. জীবনের সর্বশেষ ফুরফুরে মেজাজে আনন্দঘন সময় অতিক্রম করেন। হযরত রহ.-এর ফুরফুরে আনন্দের ঢেউ তখন গোটা পরিবারেই বয়ে যায়। সকলের মনেই যেন আনন্দের দোল খেয়ে যায়। প্রতিদিন সকালে ভোরে ঘুম থেকে উঠার পর বসিয়ে দিলে খাবারের চাহিদা বোঝা যেতো। তখন নরম ও মিষ্টি জাতীয় বিস্কুট হাতে দিলে খুব আগ্রহসহ তা হাতে তুলে নিতেন। হাতে নিয়ে বিস্কুটের এপাশ ওপাশ মনোযোগসহ দেখতেন। এরপর আস্তে মুখে তুলে নিতেন। দাঁতবিহীন শুধু মাড়ি দিয়েই চিবিয়ে চিবিয়ে বিস্কুটটি খেতেন বেশ যতœ নিয়ে। একটি শেষ হলে আরেকটি, এভাবে এক প্যাকেট বিস্কুট খেয়ে ফেলতেন। একটি একটি করে বিস্কুট হযরতের হাতে তুলে দেয়া কতোটা তৃপ্তিদায়ক আর সেই দৃশ্য দু’চোখ ভরে দেখা কতোটা উপভোগ্য ছিল। আহ! তা কি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব?
আব্বাজান হযরত শাইখ রহ. সুস্থ থাকাকালীন আল্লাহ তা’য়ালার দুটি নেয়ামতের কথা প্রায়ই স্মরণ করতেন। এক. খাবার খুব ভালো হজম হয়। দুই. ভালো ঘুম হয়। জীবনের এই পড়ন্ত সময়েও এ দু’টি নেয়ামত অব্যাহত ছিল। 
মৃত্যু রোগের সূচনা 
জুলাই মাসের ১৪/১৫ তারিখের দিকে অবস্থার অবনতি হতে থাকে। খাওয়া দাওয়া কমতে কমতে একেবারে বন্ধই হয়ে যায়। কিছুই মুখে তুলেন না। এভাবে প্রায় ১২/১৩ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর খাওয়ানোর জন্য কিছুটা পীড়াপীড়ি করতে হয়। এমনি সময় ১৬ জুলাই দুপুরের দিকে চোখ উল্টে কেমন যেন হাত পা ছেড়ে দেন। এরপরে খাওয়ানোর জন্য চাপাচাপি করা সঙ্গত মনে হয়নি। উঠিয়ে বসানোও সম্ভব হয়নি। প্রায় দুই দিন যাবৎ এমন খাবার বন্ধ থাকলে সবার মাঝে চরম উৎকণ্ঠা দেখা দেয় এবং ১৭ জুলাই মঙ্গলবার সন্ধ্যা নাগাদ আবার বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। 
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে   ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় অবস্থা তখন খুবই নাজুক। হার্ডবিট কমে গেছে, পালসও ঠিক নেই।  শ্বাস-প্রশ্বাসও স্বাভাবিক না। সবমিলিয়ে কঠিন অবস্থা। হার্ট ও লাঞ্চ কোনোটাই ঠিক মতো কাজ করছে না। এই ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে সাধারণত  আই.সি.ইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) তে নেয়া হয়। ডা. আজাদ সাহেব তখন হাসপাতালের বাইরে। ডিউটি ডাক্তার টেলিফোনে সার্বিক অবস্থা জানালেন। পারিবারিকভাবে পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্তের ভার ডা. আজাদ সাহেবের উপর ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সেমতে ডা. আজাদ সাহেব বললেন, এই অবস্থাতে হুজুরকে আই.সি.ইউতে নেয়ার প্রয়োজন নেই। হুজুরের বয়স ও শারীরিক যে অবস্থা তাতে আই.সি.ইউর বিশেষ ব্যবস্থা তেমন উপকারি হবে না; বরং হুজুরের কষ্ট হবে।  ডা. আজাদ সাহেবের এই কথার প্রেক্ষিতে ডিউটি ডাক্তারগণ আই.সি.ইউতে না নিয়ে কেবিনে রেখেই চিকিৎসার ব্যবস্থা নিলেন। আর আমাদেরকেও ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন যে কোনো মুহূর্তে বিদায়ের সম্ভাবনার কথা।
হাসপাতালে নেয়া, ভর্তি করাসহ সার্বিক বিষয়ের তত্ত্বাবধান মাহবুব ভাইয়ের মাধ্যমেই হচ্ছিল। তাৎক্ষনিকভাবে যে সকল ওষুধ বা চিকিৎসা সামগ্রীর প্রয়োজন সেগুলো জোগাড় করতে মাহবুব ভাইয়া ছোটাছুটি করতে ছিলেন। ওদিকে আব্বার অবস্থা ক্রমাগত অবণতির দিকে। পুরুষদের মধ্যে ঐ মুহূর্তে সেখানে আমি আর নাঈম (মাহমুদ ভাইয়ের বড় ছেলে) ছিলাম। ডিউটি ডাক্তার আমাদের দুজনকে আলাদা ডেকে বললেন, ‘হুজুরের অবস্থা  বেশি ভালো না, যতোটুকু সময় আছেন আপনাদের মাঝেই থাকুক। এ জন্য আজাদ স্যার আই.সি.ইউতে নিতে বারণ করেছেন।  ‘যতোটুকু সময় আছেন’ শব্দগুলো যেনো তীরের মতো বিদ্ধ হলো হৃদয়ের গভীরে গিয়ে। বুকের বাম দিকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। আমি আর নাঈম পরস্পর একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে। এরপর ধীর পায়ে ডাক্তারের কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে ফোন করলাম বাসায়। ছোট বোনকে বললাম, আব্বার অবস্থা বেশি ভালো না, তাড়াতাড়ি আম্মাকে নিয়ে হাসপাতালে আস। মাহমুদ ভাইকে ফোন করলো নাঈম। মাহফুজ ভাইকে ফোন করে বললাম, আব্বার অবস্থা বেশি ভালো না। তাড়াতাড়ি আসা দরকার। তিনি বেফাকুল মাদারিসের কোনো জরুরি মিটিংয়ে ছিলেন। বললেন, আসছি। পুরা পরিবারে খবর ছড়িয়ে পড়লে কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই ছুটে আসল বারডেম হাসপাতালের বার তলায়। 
ইতিমধ্যে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায়  বোঝাগেল, মূল সমস্যা হয়েছে লাঞ্চে। খাবার খাদ্য নালীতে না গিয়ে শ্বাস নালিতে ঢুকে লাঞ্চে গিয়ে জমা হয়েছে। লাঞ্চের কাজ হল পাঞ্চিংয়ের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস সচল রাখা। লাঞ্চে খাবার জমা হয়ে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছে এবং পাঞ্চিংয়ের কাজ ঠিকমতো করতে পারছে না। ফলে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এরই উপসর্গ হিসেবে পালস ও হার্টবিটও কমে গিয়েছে। তাই শ্বাস-প্রশ্বাসের বিকল্প হিসেবে দ্রুত জরুরি অক্সিজেন দেয়া হলো।
অবস্থার কিছুটা উন্নতি 
অক্সিজেন দেয়াতে আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি হতে লাগলো। এক পর্যায়ে লাঞ্চের ইনফেকশন ভালো করতে  নেবু লাইজার দেয়া হলো। সেটাও বেশ দ্রুত কাজ করলে মধ্য রাতের দিকে আশঙ্কা অনেকটা কমে গেল। কয়েকজন বাদে অবশিষ্টরা ধীরে ধীরে বাসায় ফিরে গেল।
আমাদের মধ্যে পর্যালোচনা হচ্ছিল যে, আমাদের জন্য এবং আব্বার জন্যও হয়তো আল্লাহ তা’য়ালা এই আসানীর ব্যবস্থা করতেছেন যে, আব্বা ধীরে ধীরে এবং ধাপে ধাপে একটু একটু করে নিঃশেষের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সকল কর্মকাণ্ড আব্বাজান হযরত শায়খকে কেন্দ্র করে এমনভাবে আবর্তিত যেমন তসবিহর দানাগুলো একটি সুতার বন্ধনে সুশৃঙ্খল থাকে কিন্তু হঠাৎ ঐ সুতাটি ছিড়ে গেলে সমস্ত দানাগুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তেমনি আমাদের বেড়ে ওঠা, কর্মময়দানে জড়িত হওয়াসহ দীনী ও দুনিয়াবি সকল কর্মতৎপরতা আব্বাকে কেন্দ্র করেই অগ্রসর হয়েছে। তাই তার অবর্তমানে আমাদের জীবন কীভাবে চলবে তা বড় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ব্যাপার ছিল।   আল্লাহ তা’য়ালার বিশেষ মেহেরবানি, হযরত শাইখের বিদায়ে আমাদের যেন বড় কোনো ঝাঁকুনি না লাগে আল্লাহ তা’য়ালা সেই ইনতেজাম করে দিয়েছেন। একটু একটু করে তিনি এমনভাবে প্রস্থান করেছেন যেন ব্যাপারটা খানিক সহনীয় হয়ে যায়। নাঈম বলতে ছিলÑ অসুস্থতা ও দুর্বলতার সর্বশেষ যে অবস্থা অনেকের হয়, মুখে খাবার খেতে পারে না, পাইপের সাহায্যে খাবার দিতে হয়। দাদার তো আলহামদুল্লিাহ এখনও ঐ অবস্থা হয়নি। আল্লাহ তা’য়ালা যদি আরও কিছু দিন দাদাকে আমাদের মাঝে রাখতেন।’
ওদিকে কৃত্রিম উপায়ে খাওয়ার ব্যবস্থা  চিকিৎসায় অবস্থার উন্নতি হওয়াতে পরদিন থেকে খাবারের বিকল্প হিসেবে স্যালাইন লাগিয়ে দেয়া হলো। এরপর এক পর্যায়ে নাক দিয়ে পাকস্থলি পর্যন্ত পাইপ স্থাপন করে খাবারের ব্যবস্থা করা হলো। ‘খাবার খাদ্য নালীতে না গিয়ে শ্বাসনালীর মাধ্যমে লাঞ্চে জমাট বাধা’ ছিল মূল সমস্যা। সেই সমস্যা এড়ানোর জন্য এই ব্যবস্থা। এভাবেই চিকিৎসা চলতে লাগল।
শরীরের বিভিন্ন ঘাটতি পুরণের জন্য বেশ কিছু ওষুধ, ইনজেকশনও স্যালাইনের মাধ্যমে দেয়া হলো। টানা নয় দিন বারডেম হাসপাতালের ১২ তলায় ১নং কেবিনে চিকিৎসা চলে। এরই মধ্যে আবার সেই চর্মরোগের সমস্যা দেখা দেয়। সঙ্গে নতুন আরেকটি কঠিন উপসর্গ তৈরি হয়। 
কঠিন এক রোগের উপসর্গ
সাধারণভাবে পেশাব হয় না বা হলেও ক্লিয়ার হয় না। ফলে কৃত্রিম উপায়ে পাইপের সাহায্যে পেশাব করানোর আবশ্যকীয়তা দেখা দিল।  এটি ছিল খুবই কষ্টকর ও মর্মন্তুদ একটি প্রক্রিয়া, যা সহ্য করা ছিল আমাদের জন্য বিরাট ধৈর্যের ব্যাপার। হাসপাতালের লোকজন মাহফুজ ভাই ও ওয়াসিফ (আমাদের ভাগিনা) কে দেখিয়ে দিল কীভাবে এই অমানবিক (?) কিন্তু অপরিহার্য কাজটি করতে হবে। মাহফুজ ভাই যিনি আমাদের মাঝে অতোটা আবেগপ্রবণ নন। কোনো পরিস্থিতিতেই সহজে ভেঙে পড়েন না। মাশাআল্লাহ হিম্মতের সাথে পিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো ছবর আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। কিন্তু এই পাইপ দিয়ে পেশাব বের করানোর বিষয়টি দেখে তিনিও চোখের পানি সংবরণ করতে পারেননি। সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় ছিল এই যে, ডাক্তাররা বললেন, এই ধরণের কৃত্রিম উপায়ে পেশাব করানোর প্রয়োজনীয়তা একবার দেখা দেয়ার পর সাধারণত আর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে না। তার অর্থ দাঁড়ায় হযরত যতো দিন হায়াতে থাকবেন, আমাদেরকে নিজ হাতেই এই হৃদয় বিদারক কাজ করে যেতে হবে।   প্রতিদিন দুই-তিন বার এভাবে পেশাব করানোর কথা বলে দিলেন। ওদিকে নাক দিয়ে খাবারের পাইপ লাগানো।  এভাবে যতোটুকু সম্ভব চিকিৎসা করে আর বাকি চিকিৎসার ব্যবস্থা দিয়ে ২৬ জুলাই- বিকালের দিকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হল। হায়াতের শেষ দুই বৎসর আব্বাজানকে  সাধারণত চিকিৎসা বা ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজনেই বাসা থেকে বাইরে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া চার পাঁচবার নেয়া হয়েছে জামিয়া রাহমানিয়ায়। সাধারণত এই যাতায়াতগুলো হতো আল মারকাজুল ইসলামীর এ্যাম্বুলেন্সযোগে। হযরত শাইখের প্রয়োজনের কথা বলে ফোন দিলেই দ্রুত এ্যাম্বুলেন্স চলে আসতো। সর্বশেষ বারের মতো ২৬ জুলাই বারডেম হাসপাতাল থেকে বাসায় নেয়ার জন্য মারকাজের এ্যাম্বুলেন্স আসল এবং সেই এ্যাম্বুলেন্সযোগে বিকাল বেলায় আমরা আব্বাকে বাসায় নিয়ে আসলাম।   জীবনের শেষ তেরদিন
২৬ জুলাই থেকে ৮ আগষ্ট। হাসপাতাল থেকে ফিরে তেরদিন হায়াতে ছিলেন।-এর মধ্যে অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা পরপর নাকের পাইপ ‘রাইস টিউব’ দিয়ে খাবার খাওয়ানো হতো। তিন সিরিনঞ্জ খাবার  আর এক সিরিঞ্জ পানি প্রতিবার দেয়া হতো। খাবার তালিকায় ছিল, খিচুরি, চালেরগুড়া, মুরগিরস্যুপ আর প্রতিদিন দুটি করে ডিমের সাদা অংশ।
জীবনের এই শেষ তেরদিন আব্বাজান হযরত শাইখের অধিকাংশ সময় কেটেছে অবচেতনে। মাঝে মাঝে কিছুটা সম্বিত ফিরত আর বাকিটা সময় কাটতো এক রকম চেখ বন্ধ করে, কখনো ঘুমে কখনো বা জাগ্রত অবস্থায়। মাঝে মাঝে চোখ খুলতেন। জাগ্রত অবস্থায় চোখ বন্ধ থাকলেও অধিকাংশ সময় জিহ্বা নড়তো এবং যুবান জারি থাকতো। তীব্র অসুস্থতার দীর্ঘ এই সময়ে ‘আল্লাহ’ আল্লাহ’ নাম ছাড়া আর কোনো অর্থবোধক শব্দ শোনা যায়নি। দুই ঘণ্টা পরপর খাবার খাওয়ানো ছাড়াও দিনে দুই তিনবার  নেবুলাইজার দেয়া হতো।   স্বাভাবিকভাবে কফ ফেলার শক্তি ছিল না তাই মাঝে মাঝে গলায় কফ জমে  শ্বাসকষ্ট হতো এ জন্য কৃত্রিম উপায়ে কফ নি:সারণের ব্যবস্থা করা লাগত। এ জন্যও আল মারকাজুল ইসলামীর হাসপাতাল থেকে অনেকবার কফ নিঃসারক মেশিন আনা হয়েছে। হযরত শায়খের এক সময়ের খাছ খাদেম মারকাজের এ্যাম্বুলেন্স বিভাগে কর্মরত মাওলানা আবদুল মুমিনকে ফোন করে দিলেই সে মেশিন ও লোক নিয়ে এসে কফ নিঃসারণ করে দিয়ে যেতো। ধীরে ধীরে এই সমস্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে সার্বক্ষণিক এই মেশিন রাখার প্রায়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই ইন্তেকালের দুই-তিন দিন পূর্বে একটি মেশিন কিনে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয় এবং দিনে এক দুইবার কফ নিঃসারণ করা হয়। 
অসুস্থতাকালে খেদমত 
আব্বাজান শয্যাশায়ী হওয়ার দুই বছর একাধারে আম্মাজান অসামান্য খেদমত করেছেন। আল্লাহর মেহেরবানী, এমনিতে আম্মা ডায়াবেটিসসহ আরো রোগে আক্রান্ত। কিন্তু আব্বার যখন সার্বক্ষণিক খেদমতের প্রয়োজন আসলো আম্মা যেনো আরো সুস্থ-সবল হয়ে ওঠলেন এবং অনন্য ও অসধারণ সেবাদান করলেন। এ ছাড়া আব্বাজানের হাতে গড়া পরিবার তার স্বপ্ন অনুযায়ী যৌথভাবেই পরিচালিত। এতে বাসায় পাঁচ পাঁচজন পুত্র বধু। বোনদের বাসাও আশেপাশে। সর্বোপরি পরিবারের সকলের ব্যকুলতা ছিল অত্যাধিক। তাই খেদমতের সুবিধার্থে  পালাক্রমে আব্বার মেয়ে, পুত্রবধু ও নাতনিগণ খেদমতে নিয়োজিত থেকেছেন। মহিলাদের ও পুরুষদের দুটি ভিন্ন ভিন্ন পালাক্রম তৈরি করা ছিল খেদমতের জন্য। খাবারের জন্য উঠিয়ে বসানো ও নড়াচড়া করানোর জন্য পুরুষদের বিশেষ প্রয়োজন পড়তো। আব্বাজান হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর পরিবারের পুরুষদেরকে আলহামদুলিল্লাহ  আল্লাহ তা’য়ালা দীনি খেদমত ও মাশগালা অনেক পরিমাণ নসীব করেছেন। এ জন্য পুরুষদের পালাক্রম পালিত হতে কিছুটা ত্র“টি হলেও বরাবরের মতো মহিলাদের ভূমিকা ছিল খুবই সক্রিয়।   বিশেষভাবে আব্বার ইন্তেকালের আটমাস পূর্বে আমাদের সেঝো আপা যিনি স্থায়ীভাবে মদিনা শরিফে বসবাস করতেন, কুদরতিভাবে এমন কিছু আসবাব তৈরি হলো যে, তাকে স্বপরিবারে দেশে চলে আসতে হলো। মদিনা শরিফ থেকে চলে আসাটা বড় কষ্টদায়ক বিষয় ছিল, সন্দেহ নেই।  কিন্তু কুদরতের মালিক মহান রাব্বুল আলামীন কোন দু:খের মাঝে কার সুখ রেখেছেন, কোন কষ্টের মাঝে কার সৌভাগ্য লুকিয়ে রেখেছেন তার আগাম ধারণা করা অক্ষম মানুষের পক্ষে কী করে সম্ভব হতে পারে? আমার এই বোনের কপালেও হয়তো অদৃশ্যের মহান কোনো খোশনসিবীর লিখন ছিল। তাই না হলে মদিনা শরিফ থেকে বাহ্যিক বিচ্ছেদের এই বিরহ যাতক ট্রাজেডি তার জীবনে পিতৃসেবার এমন সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দেবে কেন? এ ক্ষেত্রে পাক কালামের শাশ্বত সেই বাণীই কেবল প্রযোজ্য হতে পারে... ‘হতে পারে কোনো জিনিস তোমাদের পছন্দ হয় না অথচ তার মাঝেই রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ।’
ডিসেম্বর’১১-এর মাঝামাঝি সময় আমাদের এই বোন তিন দশক পর দেশে ফিরে এসে সার্বক্ষণিকভাবে আব্বাজানের খেদমতে নিয়োজিত হন। মদিনা পাগল, আশেকে রাসূল শাইখুল হাদীসের জন্য এ যেনো ছিল মদিনার তোহফা। আব্বাজান হযরত শায়খের রোগ-শোক যেমন অতীতের তুলনায় শেষ সাত-আট মাস বেশি থাকায় খেদমতের প্রয়োজন ছিল বেশি, ঠিক তেমনি কুদরতি এন্তেজামে মদিনার বোন ও তার কণ্যাগণ এস খেদমতের তালিকায় যুক্ত হয়ে পড়েন। সমস্যা আসার পূর্বেই সমাধানের এই আয়োজনকে দয়ালু আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে গায়েবি নেযামই বলতে হয়।   আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের আম্মাজান, আব্বার ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধু, নাতি, নাতনীসহ সকলকে উত্তম বদলা দান করুন। সারা জীবন আব্বাজান হযরত শাইখ যেমন মমতার প্রতিপালনে ভালোবাসার বন্ধনে গড়ে গেছেন তার বিশাল পরিবার। পরিবারের সদস্যগণও তার বার্ধক্যের দুর্বলতার সময়ে নবজাতক শিশুর মতো পরম মমতায় তাকে আগলে রেখেছেন, সোহাগে সোহাগে ভরে দিয়েছেন তার নিষ্পাপ জীবন।
 লেখক : সাহেবজাদা, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.          
 সম্পাদক, মাসিক রাহমানী পয়গাম

Powered by Create your own unique website with customizable templates.