• প্রথম পাতা
  • আরবী সাহিত্যে শাইখুল হাদিস সেমিনার
    • হযরত পাহাড়পুরী হুজুর দা: বা:
    • শাইখুল হাদিস আল্লামা আশরাফ আলী
    • মুফতি আব্দুল মালেক দা: বা:
    • মাওলানা আব্দুল মতিন বিন হুসাইন
    • মুফতি মাহফুজুল হক দা:বা:
    • মাওলানা শহিদুল্লাহ ফজলুল বারী ও উবায়দুর র
    • মাওলানা আব্দুল জব্বার দা: বা:
    • ড: শামসুল হক সিদ্দিকি দা:বা:
    • মাওলানা যায়নুল আবেদীন
  • শাইখুল হাদিস কনফারেন্স
    • উলামা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য প্রö
    • উলামা ওরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা-২
    • উলামা ওরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা-৩
    • হাফেজ উমর রহ:
    • শাইখূল হাদিস মামুনুল হকের ভাষণ
    • তারানা- সাঈদ আহমাদ
  • রাহমানিয়া ছাত্র কাফেলা স্মৃতি আলোচনা
    • স্মৃতি আলোচনায় মাওলানা মামুনুল হক
    • স্মৃতি আলোচনায় মুফতি সাঈদ আহমাদ
  • জীবনের বাঁকে বাঁকে
    • আব্বার শাসন ও সযত্ন অনুশীলন
    • আমার আম্মার কথা
    • লেখাপড়ার সুচনা
    • হযরত শামছুল হক ফরিদপুরীর সাহচার্য আমার জী
    • আমার তালিম ও তরবিয়াতে হযরত ফরিদপুরির দরদ ও &#
    • হযরত রফিক আহমাদ কাশ্মিরী রহ. এর কথা
    • হাদিসে রাসুল সা. এর প্রথম পরশ
    • দাড়িয়ে তব দুয়ার মাঝে
    • অধমের মাথায় হযরত থানভীর পাগড়ি
    • হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.
    • হুজুরের স্নেহের একটি নমুনা
  • সরাসরি সম্প্রচার
  • প্রধান কলাম সমূহ
    • বিদায় বাংলার শাইখুল হাদিস
    • উলামায়ে দেওবন্দের পতাকাবাহী
    • এক আল্লাহ ছাড়া কারো ভয় ছিল না
    • শাইখুল হাদিসকে যেমন দেখেছি
    • শাইখুল হাদিস রহ. স্মরণে
    • আমার জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক
    • হেফাজতে দ্বীনের জন্য শায়েখের আদর্শ গ্রহন 
    • শাইখুল হাদিসের স্মৃতিকথা, তাযকিরাতুল আজিö
    • শাইখুল হাদিস অনুদিত বুখারী শরীফ
    • জীবনের বেলাভূমিতে প্রিয়তম শাইখুল হাদিস
    • নবী প্রেমের কবি
  • জীবনউপলদ্ধি
    • তার জীবন আমাদের উপমা
    • ঘরে বাইরে শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক র
    • আদর্শ শিক্ষক যার শ্রেষ্ঠ পরিচয়
    • শাইখুল হাদিসের জীবনী পাঠ্য করা হোক
    • মওতুল আলেমি মওতুল আলমি
    • আজ আমি এতিম
    • অনন্য শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক
    • তিনি আমাদের বুখারীর ইমাম
    • আললামা
    • গন্তব্যে আমৃত্যু অবিচল
    • তিনি কোটি মানুষের প্রেরনা
    • দ্বীনের সফল মহানায়ক
  • গবেষনা
    • হকের উপর অটল এক ব্যক্তিত্ব
    • অসাধারন গুনাবলীর অপূর্ব সমাহার
    • হাদিস চর্চায় কালজয়ী অবদান
    • আমার দেখা শাইখুল হাদিস
    • তিনি কেন অসাধারণ
    • ঈমানদীপ্ত এক বীরের গল্প
    • রহমানিয়া ও শাইখুল হাদিস রহ.
    • আপনি ঘুমাতে পারেন না
    • রাজনীতিবিদ শাইখুল হাদিস
    • বাবরী মসজিদ লংমার্চ
  • অনুভূতি
    • আমার অনুভূতি
    • দীনের দরদী খাদেম
    • তার সাথে আমার জীবনাচার
    • শাইখুল হাদিসকে যেমন দেখেছি
    • হাদিসের দিকপাল
    • মহানুভবতার উজ্জল দৃষ্টান্ত
    • ইলম ও আমলের প্রানময় বটবৃক্ষ
    • স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
    • শাইখুল কুরআন
    • আদর সোহাগে গড়েছেন এক আদর্শ পরিবার
    • যে রত্ন আজ হারিয়ে খুজিঁ
  • স্মৃতি আলোচনা
    • প্রিয় রাহবারের শবযাত্রার মিছিলে ৩০ ঘন্টা
    • কতো স্মৃতি কতো কথা
    • সুযোগ পেলেই তার কপালে চুমু খেতাম
    • স্মৃতির পাতায় শাইখুল হাদিস
    • যার জিকিরে গুন্ঞ্জরিত মাদরাসা
    • শাইখুল হাদিস জিন্দাবাদ নয়
    • স্মৃতিগুলো জেগে থাকে মনে
    • স্মৃতি ও স্বপ্ন
    • স্মৃতিতে শাইখুল হাদিস
    • স্মৃতিগুলো এলোমেলো
    • মনের মুকুরে
    • সবই আছে শুধু নানাজি নেই
    • স্মৃতির পাতায় শাইখুল হাদিস
  • একান্ত সাক্ষাতকারে শাইখুল হাদিস
  • শাইখুল হাদিসের বৈচিত্রময় জীবন-সাধনা
    • বংশ ও পূর্ব পুরুষ
    • জন্ম ও শৈশব কাল
    • শিক্ষা জীবন
    • উল্লেখযোগ্য শিক্ষকবৃন্দ
    • শিক্ষকতা
    • রচনা ও সংকলন
  • স্মৃতি তারানা
    • তুমি সত্য ন্যায়ের বাতি
    • এতিম হলো দেশ
    • তার বিদায়ে কেঁদেছে মানুষ
  • ছবি গ্যালারী

শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর স্মরণে
অধ্যাপক মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ

আজ আমি অতি ভারাক্রান্ত মনে আমার প্রাণপ্রিয় উস্তাদ ও পরম আত্মীয় শ্বশুর আব্বা হযরত শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. সম্পর্কে দু’চার কথা লিখতে বসেছি। যার সান্বিধ্যে আমি অর্ধ শতাব্দিরও বেশি সময় কাটিয়েছি এবং তাকে অতি নিবিড়ভাবে দেখার ও জানার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। তিনি শুধু স্বদেশ বিখ্যাতই ছিলেন না, বরং উপমহাদেশের উলামায়ে কেরামের নিকট ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। তার অসাধারণ মেধা, প্রজ্ঞা, বাগ্মিতা, পবিত্র কুরআন-হাদীসে তার ব্যুৎপত্তি এবং কুরআন-হাদীসের অধ্যাপনা ও বিশদ ব্যাখ্যার জন্য তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি দেশ-বিদেশের আলেম সমাজের অন্তরে স্থান করে নিয়েছিলেন। অসাধারণ আলেমেদীন ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাঁটি ওয়ারেস হিসাবে সাধারণভাবে মানব জাতির জন্য এবং বিশেষভাবে মুসলমান জাতির জন্য তার দরদ, স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দীনী খেদমতের জন্য দেশ ও জাতির নিকট তিনি অমর হয়ে থাকবেন। থাকবেন বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সার্বজনীন পথনির্দেশক ও আলোকস্তম্ভ হয়ে ।  
২.
হিজরি ১৩৭০ সাল মোতাবেক ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দ। জামেয়া কুরআনিয়া লালবাগ মাদরাসার প্রতিষ্ঠা বছর। অধম ১৩/১৪ বছর বয়সে অত্র মাদরাসায় ‘কাফিয়া’ জামাতে ভর্তি হই। সেই ৫০ এর দশকে শাইখুল হাদীস রহ. ত্রিশোর্ধ বয়সের প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা একজন যুবক শিক্ষক। কিন্তু সেকালেই শিক্ষক পরিমণ্ডলে তার সুনাম সুখ্যাতির অবস্থা ছিল বিস্ময়কর। পবিত্র কুরআন-হাদিস ও আরবি সাহিত্যে তার সমধিক পারদর্শিতার কথা সকলের মুখে মুখে। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর নিকট আমাদের ‘নফহাতুল আরব’ নামের সাহিত্য গ্রন্থের ক্লাস পড়েছিল। ‘সৌভাগ্য’ এ জন্য বললাম যে, সে সময়ই তিনি উচ্চতর ক্লাস দাওরায়ে হাদীসের কিতাবাদি পড়াতেন। এমনকি ইতোপূর্বে আশরাফুল উলূম মাদরাসায় নিয়োগের বছরেই মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (সদর সাহেব হুজুর) রহ. তাকে মেশকাত শরিফ পড়াতে দেন এবং নিজ হাতে তার মাথায় পাগড়ি পরিয়ে মাদরাসা মসজিদে জুমার নামাজ পড়াতে বলেন। 
শাইখের মধ্যে আমরা ছাত্র জীবনের শুরুতেই যে বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলাম, তা হলো সীমাহীন দরদের সঙ্গে ছাত্রদের গড়ে তোলা। ক্লাস আরম্ভ করার প্রাথমিক পর্যায়েই তিনি আমাদের বলে দিলেন, তোমরা আমার ক্লাসে কিতাব নিয়ে আসবে না, বরং আগামি দিনের ক্লাসে যতোটুকু পড়ার সম্ভাবনা ততোটুকু খাতায় সুন্দর করে লিখে নিয়ে আসবে। উস্তাদের নির্দেশানুসারে আমরা হাতে লিখে খাতা নিয়ে এসে ক্লাস করতে লাগলাম। ক্লাসের শুরুতেই তিনি এক এক জনের খাতা নিয়ে লেখা দেখতেন এবং সুন্দর নমুনার কিছু না কিছু আরবি লেখা লিখে দিতেন। ফলে, আমার যতদূর মনে পড়ে, এক বছরের মধ্যে আমাদের প্রায় সকলের হাতের লেখাই সুন্দর হয়ে গেল। 
শাইখ রহ.-এর আরবি সাহিত্যের ক্লাসে আরেকটি আকর্ষণ ছিল, তার আজীব ঢং এ আরবি কাব্য পাঠ। তার পড়ার সাথে সাথে আমরা নিঃশব্দে তার কাব্য পাঠের ভঙ্গির অনুকরণ করতাম। তার ক্লাসে গদ্যাংশের এবারত ছাত্ররা নিজ স্বাধীন ভঙ্গিতেই পড়ত, কিন্তু পদ্যাংশ শাইখের আদর্শ ভঙ্গিতেই পড়তে হতো। তার ক্লাসে আভিধানিক ও ব্যাকরণগত তাহকীকাত করার গুরুত্ব তো ছিলই। এতে করে স্বল্প দিনেই শাইখের ক্লাসের ছাত্ররা আরবি সাহিত্যে পাকা ও পারদর্শী হয়ে ওঠত। ফলে, তারা অপরাপর কিতাবেরও আরবি এবারত নির্ভুলভাবে পড়ার যোগ্যতা হাসিল করে ফেলত। 
হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এখানেই ক্ষান্ত হতেন না। আরবি ভাষায় ছাত্রদের বক্তৃতা শেখানোরও তার অদম্য প্রচেষ্টা ও কৌশল ছিল। সেকালে আরবিতে বক্তৃতা দিতে পারাটা ছিল একটা দুর্লভ ব্যাপার। তাই তিনি ছাত্রদের উৎসাহিত করে এ ব্যাপারে তার নিজ ছাত্রজীবনের বিশেষ কৌশলের কথা উল্লেখ করে বলতেন, তিনি প্রথম প্রথম খাতায় আরবিতে বক্তৃতা লিখে মুখস্ত করতেন এবং সভায় তা শোনাতেন। শ্রোতাদের মনে হতো তিনি উপস্থিত বক্তৃতা দিচ্ছেন। অবশ্য এ কৌশল ছিল তার ছাত্রজীবনের প্রথম দিকের ব্যাপার। নতুবা ছাত্রজীবনের শেষের দিকে যে ক্ষেত্রে তিনি স্বরচিত কাব্য পাঠ করে বক্তৃতা করতেন, সেক্ষেত্রে আরবি গদ্যে উপস্থিত বক্তৃতা তো মামুলি বিষয় ছিল। প্রসঙ্গত  উল্লেখ্য যে, তিনি লালবাগ মাদরাসায় একদিন আমাদের বুখারি শরিফের ক্লাস নিচ্ছিলেন, এমন সময় তদানিন্তন সৌদি রাষ্ট্রদূত মাদরাসা পরিদর্শনে এসে হযরত প্রিন্সিপাল সাহেব রহ. ও মুফতি আব্দুল মুয়িজ সাহেব রহ.কে সাথে নিয়ে দাওরার ক্লাসের সামনে এলেন। আর অমনি শাইখ আরবিতে বুখারির তাকরীর আরম্ভ করে দিলেন। জনাব রাষ্ট্রদূত বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ অত্যন্ত আনন্দসহ তার আরবি তাকরীর শুনলেন। 
ছাত্রদের তরবিয়ত ও চারিত্রিক দিকের প্রতিও তার দৃষ্টি যে কেমন ছিল, সে সম্বন্ধে একটি ঘটনা বলিÑ লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়া প্রতিষ্ঠার প্রথম বা দ্বিতীয় বছরের কথা। আমাদের ওপরের (সম্ভবত) ‘জালালাইন’ ক্লাসের একজন ছাত্র কোনো বিষয়ে একপক্ষ নেন, আর অন্য সবছাত্র বিপক্ষ অবলম্বন করেন। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় যে, একদিন তারা সকলে সেই ছাত্রটির উপর চড়াও হয় এবং তাদের একজন সকলের সমর্থপুষ্ট হয়ে তার গায়ে একটি ঘুষি বা থাপ্পর লাগিয়ে  দেয়। সম্ভবত ছাত্রটি আত্মরক্ষার্থে দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসলে আমরা ছাত্র শিক্ষক ঘটনাটা জেনে ফেলি। 
ব্যস, আর কী। অমনি হযরত শাইখ রহ. সকল শিক্ষকের সমন্বয়ে মাদরাসা কমিটির মিটিং ডাকলেন। হযরত সদর সাহেব রহ. সম্ভবত নিজ দেশের বাড়িতে ছিলেন। কমিটির সেক্রেটারি জনাব হযরত মাওলানা দীন মুহাম্মাদ খান রহ.সহ অনেক সদস্য ও আসাতেযায়ে কেরাম এবং সকল ছাত্রদের উপস্থিতিতে এ সভায় সর্বাগ্রে যিনি বক্তৃতা করলেন তিনি হযরত শাইখুল হাদীস রহ.। আমি অধম প্রায় ৬০ বছর আগের সে দৃশ্যটি এ মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি। শাহী মসজিদে অনুষ্ঠিত সভায় দাঁড়িয়েই তিনি চিৎকার দিয়ে ওঠলেন এবং কান্নারত অবস্থায় অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী তাকরীরে বললেন, ‘এ-ই কি জামেয়া কুরআনিয়া প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল? আজ এ কি ঘটনা ঘটে গেল? এ তো মাদরাসা প্রতিষ্ঠার আদর্শের স¤পূর্ণপরিপন্থী।’ মোটকথা, তার বক্তৃতায় শ্রোতারা অত্যন্ত আবেগআপ্লুত ও প্রভাবিত হলেন। আরও অনেকের তাকরীর ও আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তগৃহিত হয় যে, মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী উক্ত ঘটনার জন্য সেই একটি মাত্র ছাত্রকে রেখে ক্লাসের আর সকল ছাত্রের নিকট থেকে মাদরাসার কিতাবাদি ফেরত নিয়ে তাদেরকে বহিষ্কার করা হবে। 
উক্ত সিদ্ধান্ত তৎক্ষণাত কার্যকর হলো। অতপর সেই ছাত্ররা নিজেদের অপরাধ উপলব্ধি করে তওবা করে এবং কয়েক দিন যাবৎ ঘুরে ঘুরে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের হাত পা ধরে অনুরোধ করে যে, এমনটি তারা আর কখনো করবে না। ফলে তাদের মাদরাসায় আবার ভর্তি করা হয়। 
বলতে কি, শুধু ছাত্রদের তা‘লীম নয়, তাদের তরবিয়ত করণার্থে হযরত শাইখেরভূমিকা ভোলার নয়। সেদিন শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে তার যে সে কান্না, অধমের স্মৃতি থেকে তা কখনো মুছে যাওয়ার নয়। ছাত্রদের কল্যাণ কামনায় তার এ অবস্থা সত্যিই হৃদয়স্পর্শী এবং একটি বিরল ঘটনা। 
পৃথকভাবেও ছাত্রদের তরবিয়তের একটি ঘটনা মনে হল। হযরত শাইখ রহ. ছাত্রদের প্রতি কেমন সুক্ষ্মদৃষ্টি ছিল সে সম্বন্ধেই এ ঘটনা। বর্তমানে লালবাগ মাদরাসার প্রখ্যাত আলেম, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির মাওলানা আব্দুল হাই সাহেব দা. বা. অধমের নিকট বলেছিলেন, ‘ছাত্র জীবনে একদা আমি স্বল্প বয়স হেতু একটি কিতাব বইয়ের মতো হাতে করে হেলাফেলা করে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তখন হযরত শাইখুল হাদীসসাহেব আমাকে দেখে সতর্ক করে বললেন, ‘একি বই-পুস্তক নাকি যে, এমনভাবে নিয়ে যাচ্ছ?’ মাওলানা গৌরব করে তার মনের কথা প্রকাশ করলেন যে, আল্লাহ তা‘য়ালার রহমতে তার মতো এমন উস্তাদদের হাতে তা‘লীম ও তরবিয়ত পেয়েছিলেন। 
হযরত শাইখ রহ. এর তরবিয়তের ধারার প্রসঙ্গটি এ জন্য দীর্ঘ করছি যে, বর্তমান কালে আমাদের মাদরাসাগুলোর ছাত্ররা তা উপলব্ধি করুন এবং যথাসম্ভব পিছনের সেই সব যুগের তা‘লীম ও তরবিয়তের অনুসরণ করতে সচেষ্ট হোক। আহ! সে কী যুগ ছিল এবং আমাদের উস্তাদগণের ছাত্র জীবন কী স্বর্ণযুগেই না কেটেছিল। আমরা তখন তাদের মুখে শুনতাম যে, দেওবন্দ মাদরাসায় পড়ার সময় তারা দেখেছেন, নামাযের জামাতে ছাত্ররা তাকবীরে উলার ফজিলত পাওয়ার জন্য মসজিদের প্রথম সারিগুলোতে স্থান দখলে প্রতিযোগিতা করতেন। 
৩.
ছাত্র জীবনে শাইখ রহ. শুধু আরবি গদ্যেই বক্তৃতা করতেন তা নয়, বরং তার সাহিত্য প্রতিভার গুণে আরবি পদ্যও রচনা  করে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। 
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের তদানিন্তন খতিব হযরত মাওলানা উবায়দুল হক রহ. কে একদা আমি এক অন্তরঙ্গ পরিবেশে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হুজুর, আপনার ও শাইখুল হাদীসসাহেবের বয়সের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে কি?’ উভয়কে তখন একইরকম বয়স্ক মনে হতো। হযরত খতিব সাহেব বললেন, ‘তিনি তো বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়। আমি যখন হিন্দুস্থানে (শরহেজামি কিতাব) পড়তে গেলাম, তখন তিনি লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরছেন। আমি যেদিন তার উস্তাদ হযরত শাইখুল ইসলাম শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ.-এর মাদরাসায় পৌঁছলাম, সেদিনই একটি ওলামা মাহফিল হচ্ছিল। মাওলানা আজিজুল হক সাহেব সেই সভায় আরবিতে বক্তৃতা এবং হযরত শাইখুল ইসলামের শানে স্বরচিত একটি কবিতা পাঠ করছিলেন। এতে আমরা অতি আনন্দিত হয়েছিলাম এবং আমরা বাঙালি ছাত্ররা অতি গৌরববোধ করেছিলাম।’

শাইখুল হাদীস রহ. এর স্মরণে করাচির জামেয়া ফারুকিয়ার মুহতামিম শাইখুল হাদীস মাওলানা সালিমুল্লাহ খান দা. বা. লেখেনÑ ‘মাওলানা আজিজুল হক সাহেবকে আমি প্রথমবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে দারুল উলূম দেওবন্দে সেই সময় দেখেছিলাম, যখন ১৩৬৫ হিজরি মোতাবেক ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে আমি দাওরায়ে হাদিসের ছাত্র ছিলাম। তখন দারুল হাদিসের ভেতর একটি সভায় তিনি সাবলীল আরবি ভাষায় বক্তৃতা করেছিলেন। সে যুগে দারুল উলূম দেওবন্দেও আরবি ভাষায় বক্তৃতার চর্চা ছিল না। তাই আমার জানার কৌতুহল হলো, এছাত্রটি কে, যে অতি নির্বিঘেœ এতো সুন্দর আরবি বলেন। জানতে পারলাম, তিনি (এখানে) দাওরায়ে তফসীরের ছাত্র এবং ঢাকার (জামেয়া কুরআনিয়া) লালবাগ থেকে শাইখুল হাদীস আল্লামা জফর আহমদ উসমানীর নিকট (প্রথমবার) বুখারি শরিফ পড়ে এসে গত বছর ডাবেলে আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানীর নিকট দ্বিতীয়বার সহীহ বুখারি শরিফ পড়েছেন। তিনি আল্লামা উসমানী সাহেবের তাকরীর অতিযতœ ও গুরুত্বের সাথে লিপিবব্ধ করেছেন। এখন (ফজলুল বারী ৩য় খণ্ড) 
শাইখের কাব্য প্রতিভার উৎকৃষ্ট প্রকাশ ঘটেছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা শরিফের নিকট বসে তার শানে লিখিত ও রওজা পাকের ধারে পঠিত কাসিদা বা কবিতাসমূহে। একবার তিনি মসজিদে নববীতে জামাতের অপেক্ষায় কাতারে বসে একটু হালকা স্বরে সেই ধরনের একটি  কবিতা পাঠ করছিলেন। পাশেই বসাছিলেন এক আরববাসি সুধি ব্যক্তি। তিনি তাকে দু’চারটা ছন্দ পড়তে শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শাইখ! তুমি কী পড়ছ?’ তখন তিনি বললেন, ‘হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে লিখিত একটি কাসিদার কয়েকটি ছন্দ। জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো কার রচিত? তখন শাইখকে বাধ্য হয়ে বলতে হলো যে তারই রচিত। এতে তিনি অনুরোধের সুরে বললেনÑ আবার পড়ে আমাকে শুনান। সে মতো শাইখ রহ. স্বরচিত কাসিদাটি সেই আরববাসি সুধি ব্যক্তিকে শোনালেন। এতে তিনি অভিতূত হয়ে গেলেন। বিশেষত এই ভেবে যে, একজন অনারব ব্যক্তি কী করে এতো সুন্দর কাসিদা রচনা করতে পারল? এরপর সেই আরব সুধী ব্যক্তি মদিনা শরিফের একাধিক স্থানে সুধি মাহফিল করে করে শাইখকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেতেন। এবং তার দ্বারা তার স্বকীয় ভঙ্গিতে তা পড়িয়ে  শুনতেন। তারপর থেকে হযরত শাইখ রহ. হজ্জের প্রায় প্রতি সফরেই একটি করে কাসিদা লিখতেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা পাকে দাঁড়িয়ে অশ্র“সিক্ত নয়নে পাঠ করতেন। পাশে দাঁড়ানো আরবিভাষী বা অন্য ভাষাভাষি আলেম ব্যক্তিরা মোহিত হয়ে যেতেন। হজ্জের সফর শেষে দেশে এসে শাইখ রহ. নিজ মাদরাসার সকল ছাত্র শিক্ষকের মাহফিলে এসব কাসিদা পড়ে শুনাতেন এবং তারাও অভিভূত হতেন। উল্লেখ্য যে, উক্ত কাসিদাগুলো তার বাংলা বুখারি শরিফে পরপর কয়েক খণ্ডের প্রথম ভাগে বরকতের জন্য এবং বাংলা ভাষাভাষীদের উপকারার্থে অর্থসহ তিনি সংযোজন করে দিয়ে গেছেন। আল্লাহ তা‘য়ালা তাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন॥ 

৪.
হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর শিক্ষাদানের পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু বলতে হলে বলতে হয়, সাহিত্যের ক্লাসে তাঁকে যেমন দেখেছিলাম, পরবর্তীকালে যখন তার হাদিসের ক্লাসে বসার সৌভাগ্য হলো, তখন দেখতে পেলাম তার সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যে তার স্বভাব সুলভ হাসি ও রসিকতা দরসের পরিবেশকে এমন আনন্দমুখর করে তুলতো যে, তাতে করে আমরা সাহিত্যরস উপভোগ করতাম এবং বিষয়টি অতি সহজে বুঝে নিতাম। আর হাদিসের ক্লাসে ছিল তার আদব ও গাম্ভীর্য। হাদিস শাস্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব বুখারি শরিফের অধ্যায়ন ও অধ্যাপনা হযরত শাইখের জীবনে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। প্রথমে তার বুখারি শরিফের অধ্যাপনার কথাই বলি। আমি অধম দু’দিকেরই পড়াশোনা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ক্লাসে বসেছি এবং স্বনামধন্য প্রফেসর ও পিএইচ, ডি অধিকারী শিক্ষকদের নিকট পড়েছি। কিন্তু বুখারি শরিফে  শাইখের যে কামাল অর্থাৎ পারদর্শীতা ও পারঙ্গমতা উপলব্ধি করেছি, তা আর কোনো শিক্ষক বা অধ্যাপকের মধ্যে আমি জীবনে পাইনি। বুখারি শরিফের অধ্যাপনায় তিনি অভিনব শিক্ষাপদ্ধতি অবলম্বন করতেন এবং দক্ষতার সাথে পড়াতেন। 

উল্লেখ্য যে, বুখারি শরিফের অধ্যাপনায় তার সুখ্যাতির ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের কর্তৃপক্ষের অনুরোধে হযরত শাইখ রহ. বিশ্ববিদ্যালয়েও কয়েক বছর বুখারির অধ্যাপনা করেন। আরো উল্লেখ্য যে, শাইখের উস্তাদ হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর জীবদ্দশায় তার স্নেহমাখা নির্দেশে তারই প্রাণপ্রিয় মাদরাসা নূরিয়াতে তিনি বহুদিন বুখারির দরস দিয়েছিলেন। সে দরসে স্বয়ং হযরত হাফেজ্জী হুজুর হযরত শাইখের পাশে এসে বসতেন। প্রিয় সাগরেদের অনুপম দরসে মুগ্ধ হয়ে কোনো কোনো সময় বলতেন, ‘মনে চাই মাওলানা আজিজুল হক সাহেবের নিকট সমস্ত বুখারি শরিফ পুনরায় পড়ে নিই।’ সে সময় হযরতের মাদরাসার আরো কয়েকজন মুহাদ্দিস শাইখের দরসে বসেছেন এবং বছরব্যাপী ক্লাস করে পুনরায় সনদ হাসিল করেছিলেন। ময়মনসিংহের মাওলানা আব্দুল হক সাহেব ও মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী সাহেব তাদের অন্তর্ভুক্ত। 
 ৫. 
আমি আলোচনার প্রারম্ভেই শাইখ রহ.এর অসাধারণ মেধা ও কালজয়ী প্রতিভার কথা উল্লেখ করেছি। সেইসঙ্গে হাদিসের সর্বশ্রেষ্ঠগ্রন্থ বুখারি শরিফ অধ্যয়নে তার পরম সৌভাগ্যও উল্লেখযোগ্য। উচ্চশিক্ষার শেষ প্রান্তে এসে তিনি পরপর দু’বছর বিশ্ববরেণ্য দু’জন আলেম ও বুখারি শরিফের অদ্বিতীয় উস্তাদের নিকট অধ্যয়ন করার দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন করেন। এর ফলেই তিনি পরবর্তীকালে বেনজীর ‘শাইখুল হাদীস’ হতে পেরেছেন। তাদের মধ্যে প্রথমজন হলেনÑ আলেমকূল শিরোমণি আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রহ.। তার ব্যাপারে শাইখুল হাদীস রহ. বলেন, ‘তিনি যে কতোবড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তা তার অদ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ইলাউসসুনান’ হাদিসের মহান কিতাব দেখলেই অনুমান করা যায়। তা ছাড়া শুধু পাক ভারতেই নয়, বরং মুসলিম জাহানে তিনি এতই সুপরিচিত যে, আমি তার সম্বন্ধে যতো কিছু লিখব, তা রেশমের জামায় চটের তালিরূপেই পরিগণিত হবে। তিনি আমার ধ্যান-ধারণার ঊর্ধের।’ 
দ্বিতীয়জন হলেনÑ শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ.। তিনি তার সময়ে পাক-ভারত উপমহাদেশের সর্বাপেক্ষা বড় আলেম ও ওলীয়ে কামেল ছিলেন। পাকিস্তানের কায়েদে আজম মরহম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ পর্যন্ত তাদের উভয়কে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং তাদের থেকে পরামর্শগ্রহণ করতেন। তাদের জ্ঞানগর্ভ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ আলোচনায় তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হতেন। ভারতবিভক্তির ফলে পাকিস্তান জন্ম নিলে পাকিস্তানের জনক কায়দে আজম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ সর্বাগ্রে আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ.-এর পবিত্র হাতে পশ্চিম পাকিস্তানের এবং আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ.-এর হাতে পূর্ব পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করিয়েছিলেন। 
বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ উস্তাদ যখন তার যথার্থ এলেম বুঝার মতো যোগ্য সাগরেদ পান, তখন অত্যন্ত উৎসাহের সাথে ও অতি আনন্দ চিত্তে তার গভীর ইলমী পাঠদানের কাজটি করে থাকেন। শাইখুল হাদীস রহ. যখন বঙ্গদেশ থেকে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে সুদূর বোম্বাইয়ের ডাভেলে গিয়ে ইলমের সাগর স্বনামধন্য উস্তাদ হযরত শাইখুল ইসলামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে তার পরিচয় দিলেন এবং আগের বছর যে ঢাকায় আল্লামা যফর আহমাদ সাহেবের কাছে প্রথমবার বুখারি শরিফ পড়েছেন বলে জানালেন, তখন শাইখুল ইসলাম রহ. দূরদৃষ্টির আলোকে বললেন, ‘আমি বিগত দশ বছর যাবত বুখারি শরিফ পড়াচ্ছি, মনে হয় এ বছরেই বুখারি আমার শেষ পড়ানো হবে। তুমি এসেছ, ভালোই হলো। আমি আশা করছি, বিগত দশবছরের সমষ্টি এ বছর পড়াবো।’ 
বাংলাদেশের আলেমকূল শিরোমণি মুরশেদে রব্বানী মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. শাইখের অনূদিত ও বিশদ ব্যাখ্যাসম্বলিত বাংলা বুখারি শরিফের মুখবন্ধে লিখেছেনÑ ‘যতোদূর আমার জানা আছে, বুখারি শরিফ বর্তমান যুগে বাংলাদেশে তার চেয়ে অধিক যতœসহকারে এবং আদ্যপান্ত বুঝে আর কেউ পড়েননি। (কেননা হযরত শাইখুল ইসলাম রহ. দৈনিক ৪/৫ ঘণ্টা করে সমগ্র বুখারি শরিফ অর্থাৎ ৩০ পারাই পড়িয়ে ছিলেন। ( কথাটি প্রবন্ধকার নিজে হযরত শাইখ রহ.-এর নিকট শুনেছিল) এবং বুখারি শরিফের খেদমতও এতোদূর কেউ করেননি। তিনি হযরত শাইখুল ইসলাম মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির আখাছ্ছুল খাছ শাগরেদ। পড়ার জামানাতেই তিনি ১৮০০ পৃষ্ঠাব্যাপী শরাহ উর্দূ ভাষায় লিখেছেন। স্বয়ং হযরত শাইখুল ইসলাম রহ. তার লেখার বিরাট অংশ দেখে দিয়েছেন, আনন্দিত হয়েছেন এবং প্রশংসা করেছেন। বলাবাহুল্য, শাইখের জন্য এর চেয়ে বড় সার্টিফিকেট আর কিছু হতে পারে না। 

৬.
শাইখুল হাদীস হিসাবে বর্তমানকালে গোটা উপমহাদেশে তার কোনোজুড়ি নেই। পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানের প্রখ্যাত আলেমগণ শাইখের অধ্যায়নকালের সৌভাগ্য এবং পরবর্তী কালে তার বুখারি শরিফের অনুপম অধ্যাপনা এবং বাংলা ভাষায় উক্ত হাদিস গ্রন্থের অতুলনীয় অনুবাদ ও ব্যাখ্যার জন্য সর্বমহলে তার খ্যাতির কথা জানেন। তার বাংলা বুখারির সর্বশেষ এডিশন হিসাবে ইতিপূর্বে ৭খণ্ডে সমাপ্ত ও প্রকাশিত গ্রন্থ ছাত্র শিক্ষকের পড়া ও পড়ানোর উপযোগী করে ১০ খণ্ড ছাপিয়ে প্রকাশ করে গেছেন। পাঠকবর্গের নিকট অনুরোধ, তারা যেন আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়া করেন, তিনি তার হাবীব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিবেদিতপ্রাণ এই খাদেমকে লেখার মাধ্যমেও বুখারি শরিফের খেদমত পূর্ণতায় পৌঁছিয়ে দিয়ে যেতে পারার জন্য অফুরন্ত প্রতিদান দেন। বলাবাহুল্য, এ উপমহাদেশের প্রধান দু’টি ভাষা বাংলা ও উর্দূতে শাইখের উপরোল্লেখিত খেদমত দু’টি ইনশাআল্লাহুল আজিজ কেয়ামত কাল পর্যন্ত তার সুনামের নিদর্শন হয়ে থাকবে এবং তিনি পরকালের অনন্ত জীবনে এর অফুরন্ত সুফল ভোগ করতে থাকবেন। 
প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ্য যে, শাইখের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা ছিল বুখারি শরিফের বাংলা ও উর্দূ শরাহ দু’টির সমন্বিত খেদমত বিশ্ব মুসলিমের প্রাণপ্রিয় কুরআনী ভাষা অর্থাৎ আরবিতেও অনূদিত হয়ে প্রকাশ হোক। ফলে, আরব-অনারব তথা বিশ্ব মুসলিম এই অদ্বিতীয় খেদমতের দ্বারা উপকৃত হতে থাকবেন। সুখের বিষয় এ লক্ষে তিনি তার আওলাদের মধ্য থেকে তার সুযোগ্য ইলমী ওয়ারেছ তৈরি করে গেছেন। শাইখ রহ.-এর বড় মেয়ের ঘরের নাতি মারকাযুদ্দাওয়াতিল ইসলামিয়ার এলমে হাদিসের খাদেম মাওলানা সাঈদ আহমাদ ‘ফজলুল বারী’ নামে বুখারি শরিফের যে উর্দূ শরাহ করাচি থেকে ইতোপূর্বে বের হয়েছিল, তার তৃতীয় খণ্ড শাইখের জীবদ্দশায় এই নামেই কিতাবী আকৃতি দান করেছেন। বর্তমানে কিতাবটি চকবাজার রশীদিয়া লাইব্রেরির মাধ্যমে প্রকাশিত ও বাজারজাত হয়েছে। ইনশাআল্লাহ অচিরেই তা ঢাকা ও দেশের বড় বড় লাইব্রেরিতে পাওয়া যাবে। আল্লাহ তা‘য়ালার ইচ্ছায় উর্দূ শরার অবশিষ্ট কাজ যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি প্রকাশ করার তাওফিক তিনি তাকে দান করবেন। তার পর ইনশাআল্লাহ আরবি প্রকাশের কাজে হাত দেওয়া হবে। আল্লাহ তা‘য়ালা তাও পরিপূর্ণতায় পৌঁছিয়ে দিন। আমিন 
৭.
শাইখুল হাদীস রহ. থেকে বুখারি শরিফের সনদ এক দুর্লভ রতœ হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল। তার ওয়াফাতের পূর্বে বেশ কয়েক বছর ধরে সমস্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদরাসা থেকে হযরত শাইখের নিকট বুখারি শরিফ পড়ার জন্য এবং তার থেকে এ কিতাবের সনদ হাসিল করার জন্য উচ্চতর ক্লাসের ছাত্ররা দলে দলে বছরের শুরুতে ঢাকায় এসে তার দরবারে হাজির হতেন। কিন্তু শাইখেরমাদরাসা জামিয়া রাহমানিয়াতে এতো ছাত্রের স্থান সংকুলান হতো না বলে তিনি আশপাশের মাদরাসায় তাদের ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। ছাত্রদের দুর্বার আগ্রহ ও সে সব মাদরাসা কর্তৃপক্ষের আকুল আবেদনে তিনি সে সকল মাদরাসা যথা লালমাটিয়া মাদরাসা, দারুস সালাম মাদরাসা ও মিরপুর জামেউল উলূম মাদরাসাসহ আরো কিছু মাদরাসায় বৃদ্ধ বয়সেও বুখারির দরস দিতে যেতেন। ইতোপূর্বে বলা হয়েছে, লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়ায় বুখারি শরিফ পড়ানোর সময় মাদরাসা নূরিয়াতেও তিনি বুখারি পড়িয়েছিলেন। এতে করে শাইখেরনিকট থেকে প্রতি বছর চার থেকে পাঁচ শত ছাত্র বুখারি শরিফের সনদ নিচ্ছিলেন। এলমে দীনের ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ হিসাবে হযরত শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক কর্তৃক প্রদত্ত বুখারি শরিফের স্বর্ণ সনদের কোনো জুড়িই ছিল না। 

৮.
ছাত্রজীবনে হযরত শাইখ রহ. এর সাধনা ও পরিশ্রম ছিল অবিস্মরণীয়। তার অসাধারণ পরিশ্রম ও সাধনা সম্বন্ধে জানাতে গিয়ে নিজেই বলেছিলেন, তিনি তখন মাত্র ৩/৪ ঘণ্টা ঘুমাতেন। ফলে যখন লেখা-পড়া থেকে ফারেগ হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন তার মনে হতো, তার মাথার মগজ যেন অকেজ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি প্রায় দেড় যুগের অক্লান্ত অবিশ্রান্ত সাধনায় যা হাসিল করেছিলেন, তা দেশের মানুষের খেদমতে বিলানোর বুকভরা আশায় অস্থির হয়ে তার এক হাকীম বন্ধুর শরাপন্ন হন। তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞ ও খ্যাতনামা চিকিৎসক ছিলেন। তিনি স্বীয় গবেষণা ও অভিজ্ঞতালব্ধ বহু মূল্যবান ধাতব উপাদানে বিশেষভাবে তৈরি ঔষধ তার প্রিয়বন্ধুকে দিতে থাকেন এবং সেই সাথে উত্তম মানের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের পরামর্শ দেন। আমরা জানি, হাকীম সাহেবের প্রদত্ত ঔষধ ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের নিয়ম তিনি সারা জীবন মেনে চলেছিলেন। ফলে তিনি আজীবন সুস্থ থেকেছেন এবং দীনের ও দীনী এলমের খেদমত করতে পেরেছেন। ওয়াফাতের দু’বছর পূর্ব থেকে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় শয্যাশায়ী হন এবং সম্বিত হারানোর পরও আমৃত্যু তার পবিত্র মুখে সর্বদা ইসমেজাত ও কলেমার জিকির জারি ছিল। 
৯.
উস্তাদদের খেদমতে হযরত শাইখ রহ. ছিলেন অতুলনীয়। আল্লাহ তা‘য়ালা শাইখকে অসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞা দানের সাথে সাথে তিনি তাকে দেশ-বিদেশের অসামান্য যোগ্যতা ও তাকওয়াসম্পন্ন উস্তাদবৃন্দ লাভের সৌভাগ্য দান করেছিলেন। সমস্ত ছাত্রজীবন ব্যাপী তিনি তাদের থেকে ইলমে দীন হাসিল করতেন এবং সেই সাথে মনে প্রাণে তাদের খেদমতও করতেন। লেখা-পড়ার সময় বাদে প্রায় সারা বছর তিনি উস্তাদদের খেদমতে নিবেদিত থাকতেন। এক দিকে ছাত্র হিসাবে হযরত শাইখ ছিলেন সকল গুণের অধিকারী, অপরদিকে সমকালের শ্রেষ্ঠ উস্তাদবৃন্দের তা‘লীম তরবিয়ত এবং তাদের আন্তরিক দোয়া তার জন্য সোনায় সোহাগারূপে প্রমাণিত হয়েছিল। এমন উস্তাদবৃন্দের সোনালি পরশে শাইখেররঙই বদলে গিয়েছিল। দেশে তাদের মধ্যে তার প্রধান উস্তাদ ছিলেন আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ.। তারপর যখন তিনি দ্বিতীয়বার বুখারি শরিফ পড়ার জন্য বঙ্গ দেশ থেকে সুদূর বোম্বাইয়ের নিকটবর্তী ডাভেলস্থ ইসলামিয়া মাদরাসায় তার সর্বশেষ উস্তাদ শাইখুল ইসলাম মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানীর নিকট পড়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন এক সময় আল্লামা যফর আহমাদ উসমানীর সঙ্গে সাক্ষাতে হযরত শাইখুল ইসলাম কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘মিয়া আজিজুল হকের মধ্যে যেন আপনার রঙ দেখা যায়।’ সে বছর ডাবেলে এবং পরের বছর দেওবন্দে অবস্থানকালে তিনি তার এ উস্তাদদেরও অনেক খেদমত করেছিলেন এবং রুহানি তরবিয়ত হাসিল করেছিলেন। 
অতএব শাইখেরপুরো ছাত্রজীবনই নিবেদিত ছিল লেখা-পড়ার সাধনায় ও উস্তাদবৃন্দের খেদমত করণে। এরই ফলে ছাত্র থাকাবস্থায়ই শাইখেরনানামুখী প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে। সে সবের মাঝে পবিত্র হাদীস শাস্ত্রে ও আরবি সাহিত্যে তার কাব্যিক প্রতিভার বিকাশ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তার আরবি সাহিত্যচর্চা শিক্ষকতার জীবনে এসে ফলে ফুলে উদ্ভাসিত হয়। 
১০.
হযরত শাইখুল হাদীস রহ. ছিলেন উস্তাদদের নয়নমণি। প্রসঙ্গত মনে হল, হযরত শাইখ রহ. তার মহান উস্তাদদের নিকট যে কতো প্রিয় ছিলেন, এ সম্বন্ধে তারই পরম আত্মীয় (অর্থাৎ আম্মার ছোট ভাই) মাওলানা মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম রহ.-এর মুখে বর্ণিত একটি ঘটনা মনে পড়লো : স্বয়ং হযরত আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. নিজে তার প্রাণ প্রিয় ছাত্র অর্থাৎ শাইখের বিয়ের পয়গাম পাঠাতে গিয়ে মাওলানার শ্রদ্ধেয় পিতাকে লিখেছিলেনÑ ‘মিয়া আজিজুল হক আমার ছেলে। হাজার মানুষের মধ্যে সে একজন। হযরত শাইখুল ইসলাম মাওলানা শাব্বীর আহমাদ রহ. স্বীয় সাগরেদ হযরত শাইখকে একটি ভবিষ্যতবাণী শুনিয়েছিলেনÑ আমার আশা যে, তোমার দ্বারা বঙ্গদেশে আমার কিছু কথা প্রসারিত হবে।’ কবি কতো সুন্দরই না বলেছেনÑ প্রকৃত আল্লাহওয়ালা যা বলেন, অন্তরচক্ষু দিয়ে দেখেই বলেন। 
আজ যখন দেখি বাংলাদেশের সব অঞ্চলে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আলেম ছাত্রগণ ছড়িয়ে আছেন, তার বাংলা বুখারি শরিফের মাধ্যমে সাধারণ ও উচ্চশিক্ষিত সকল মহলের মানুষ এলমে হাদিসের স্বাদ উভোগ করছেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকা মতো জীবন গড়ছেন, তদুপরি তার উর্দূ বুখারি শরিফের যে দু’খণ্ড পাকিস্তান থেকে ছাপা হয়েছে, তা পড়ে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানের আলেম ও গায়রে আলেম মুসলমান উপকৃত হচ্ছেন, তখন আর তার শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদ হযরত শাইখুল ইসলামের ভবিষ্যতবাণীর বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করে শাইখেরউস্তাদ জগতবিখ্যাত আলেম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে আল্লাহর মহান ওলিও ছিলেন, তা সহজেই অনুমেয় হয়। 
১১.
আরবি সাহিত্যে তার কৃতিত্ব ও এলমে হাদিসে তার অসামান্য দক্ষতা ও পারদর্শিতার বিষয় আরজ করার পর এলমে তাফসিরেও যে তার অসামান্য দক্ষতা ছিল, সে কথা কিছু না বললে তার এলমী আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় বলে মনে করি। 
হযরত শাইখ রহ. বলেছিলেন, তিনি যখন ছাত্র, তখনকার সময়ে ক্লাসে কুরআন শরিফের তরজমা পড়ানো হতো না, সরাসরি আরবি তাফসির পড়ানো হতো। তাই তিনি কালামে পাক উত্তমরূপে বোঝার জন্য তফসীর পড়ার পূর্ববর্তী বছর কয়েকজন মেধাবী ছাত্রের সমন্বয়ে ‘বয়ানুল কুরআন’ ও ‘ফাওয়ায়েদে উসমানী’ এর অনুসরণে কুরআনের তরজমা আয়ত্ব করে তাকরার শুরু করেন। এতে দাওরায়ে হাদিসেরও কিছুছাত্র এসে শামিল হতেন। আরও একটি আশ্চর্যের কথা এই শুনেছি যে, আরবি সাহিত্যের বিখ্যাত কিতাব ‘মাকামাতে হারিরি’ পড়ার বছর এ কিতাবের কোন কোন শব্দ কুরআন শরিফের কোথায় কোথায় আছে তা অক্লান্ত পরিশ্রমসহ খুঁজে খুঁজে বের করেন, যাতে আল্লাহ তা‘য়ালার কালামের মর্মার্থ উত্তররূপে বুঝতে পারেন এবং দলীলরূপে উক্ত কিতাবের শরাহতে দেখাতে পারেন। 
তিনি ছাত্রাবস্থাতেই ‘মাকামাতে হারিরির’ মতো সাহিত্যের অত্যন্ত কঠিন কিতাবের উর্দু শরাহ (বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ) লিখে ফেলেন, যা পরবর্তীকালে সাহিত্যে শিক্ষকগণ অত্যন্ত যতœসহ পড়তেন এবং সে অনুযায়ী কৃতিত্বের সাথে সেই কিতাবখানি ছাত্রদের পড়াতেন। এ ছাড়া ছাত্রজীবনে তিনি আরও কোনো কোনো কঠিন কিতাব এমনকি হাদিস গ্রন্থেরও শরাহ লিখেছিলেন। যেগুলো পরবর্তী কালে উস্তাদদের জন্য বিরাট সহায়ক হিসাবে প্রমাণিত হয়। ক্লাসে উস্তাদদের তাকরীর (ব্যাখ্যা বক্তব্য) ছাড়াও প্রত্যেক কিতাবের যতো শরাহ পাওয়া যেত, সেগুলোও তিনি সংগ্রহ করে পড়তেন। অতপর তার অসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞাবলে প্রত্যেক বিষয়ে বড় কিতাবের আজীব ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যাখ্যা লিখতেন। 
একবার তিনি বলেনÑ ‘মানতিক বা দর্শন শাস্ত্রের কিতাব ‘সুল্লাম’ পরীক্ষায় মূল তিনটি প্রশ্নের একটির উত্তর লিখে সেরেছি তখন পরীক্ষার সময় (৩ ঘণ্টা) শেষ হয়ে গেছে এবং জোহরের নামাজের আজানও হয়ে গেছে। আমি উস্তাদদের এ কথা বিনীতভাবে জানালে হযরত সদর সাহেব হুজুর তা অবগত হলেন। হুজুর অতি শফকত ও মুহাব্বতের সঙ্গে বললেন, ‘আচ্ছা আজিজুল হকের অবশিষ্ট পরীক্ষার গার্ড আমিই দেবো। বাদ জোহর হুজুর যথাস্থানে বসে থাকলেন আর আমি লিখতে থাকলাম। এমন সময় আছরেরও আজান হয়ে গেল, এমনিভাবে আছরের পরেও লিখলাম। অথচ আমার উত্তর লেখা তখনো শেষ হয়নি। কিন্তু হুজুর এতেও অধৈর্য হননি, বরং বললেনÑ ‘ঠিক আছে বাদ মাগরিব আমার নিকট বসে উত্তর লিখে পরীক্ষা শেষ করবে।’ ঠিক তাই হল। আমার মনে আছে বাদ মাগরিব হুজুর তার স্থানে এসে আওয়াবীন পড়তে থাকলেন এবং তিনটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর লিখে এশার নামাযের পূর্বে খাতা জমা দিলাম। সদর সাহেব হুজুর আমার খাতা খুশিচিত্তে জমা নিলেন। সুহৃদ পাঠক! এমন বিরল ঘটনার কথা কোথাও কখনো শুনেছেন কি?’
শাইখ রহ.-এর বুখারির উর্দূ শরাহ ফজলুল বারী এর ৩য় খণ্ডের মুখবন্দে বর্তমানে পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠতম আলেম মাওলানা তাকী উসমানী দা. বা. হযরত শাইখকে ‘শাইখুল কুল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। 
একবার ঢাকার খাজে দেওয়ান মসজিদে একজন আলেম কর্তৃক কয়েক বছরে পবিত্র কুরআনের তাফসির শেষ হলে মসজিদের বাইরে প্রশস্ত ও দীর্ঘ রাস্তায় সামিয়ানা টানিয়ে শেষ সূরা দুখানির তাফসিরে খতমে কুরআন ও দো‘য়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর সভাপতিত্বে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. সূরা দুখানি অর্থাৎ সূরা নাস ও সূরা ফালাক-এর তাফসির করতে থাকলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপর হযরত হাফেজ্জী হুজুরের প্রশংসা করে শ্রোতাদের সম্বোধন করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘এভাবে এ দু‘টি সূরার ব্যাখ্যা ও তাফসির আমি ইনশাআল্লাহ রাতভর করতে পারব। এখন চিন্তা করুন আমাদের সামনে বসা আমার উস্তাদ হযরত হাফেজ্জী হুজুরের কুরআন পাকের এলেম কেমন হতে পারে।’ দীনহীনের অতি বড় সৌভাগ্য যে, অধমও ওই মাহফিলে শ্রোতা হিসাবে উপস্থিত ছিল। 
১২.
শাইখুল হাদীস রহ.এর উল্লেখিত দুজন কালজয়ী উস্তাদই সুলুক ও তাসাউফের লাইনে হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আরশাফ আলী থানভী রহ.-এর হাতে তরবিয়তপ্রাপ্ত। আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. ছিলেন হযরত থানভী সাহেবের ভাগ্নে ও অনেক কিতাবের ছাত্র। আর আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ. ছিলেন হযরতের রুহানী সন্তান তথা বায়াত দানের এজাজতপ্রাপ্ত খলীফা। এ থেকে হযরত শাইখুল হাদীস রহ.এর জীবনের আরেকটি বিশেষ দিক অর্থাৎ সুলুক ও তাসাউফের লাইনে তাকমিলে এসলাহ বা আত্মাসংশোধনের পূর্ণতা প্রাপ্তির সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আল্লাহ তা‘য়ালার একটি নিয়ম রয়েছে যে, তিনি তার যে বান্দাকে দিয়ে পরবর্তীকালে উম্মতের ইলমী ও দীনী খেদমত নেবেন, বাল্যকাল থেকেই তার তা‘লীম ও তরবিয়তের যথাযথ ব্যবস্থা তিনি নিজ কুদরতে করে থাকেন। হযরত শাইখের জীবনেও আমরা আল্লাহ তা‘য়ালার সে নিয়মের বাস্তবায়ন দেখতে পাই। বাল্যকালে ৭/৮ বছর বয়স থেকে তার লেখা-পড়ার দায়িত্ব এমন তিন মনীষীর মুবারক হাতে এসে পড়েছিল, যারা হযরত হাকীমুল উম্মত হযরত থানভীর দরবারে এসলাহে নফস ও এসলাহে আমলের পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। উক্ত তিন মহামনীষী হচ্ছেন, হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হজুর রহ. ও হযরত মাওলানা পিরজী হুজুর রহ.। হিন্দুস্থানে ব্যয়িত দু’বছর বাদে শায়েখের সমস্ত ছাত্র জীবন এই তিন যুগশ্রেষ্ঠ ওলির সান্নিধ্যে ও সুহবতে এবং তা‘লীম ও তরবিয়তে কেটেছিল। 
তাদের মধ্যে প্রথম দু’জনের তরবিয়ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হযরত শাইখ রহ.-এর কথায়, ‘আমার রুহানী ও ইলমী পিতা মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.। আমার আট বছর বয়স থেকে তার শেষ জীবন পর্যন্ত ৪০ বছরের অধিক কাল আমাকে সবরকম ফয়েজ-বরকত দানে ধন্য করেছেন।’ হযরত সদর সাহেব ফরিদপুরী রহ. এর মতো আল্লাহর ওলী সূফিকুল শিরোমণি মুরশিদে রাব্বানী বলেছিলেনÑ‘আমাকে যদি পরকালে আল্লাহ জিজ্ঞেস করেনÑ শামছুল হক! তুমি আমার সামনে পেশ করার মতো কী নিয়ে এসেছ?’ তখন আমি মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ ও মাওলানা আজিজুল হককে পেশ করে বলবÑ ‘আয় আল্লাহ! আমি তোমার জন্য এদের দু’জনকে নিয়ে এসেছি।’
শাইখ রহ.-এর সর্বশেষ উস্তাদ আল্লামা শাব্বীর আহমাদ সাহেবের নিকটও তার রুহানী তরবিয়ত হয়েছিল। সে সম্পর্কে হযরত সদর সাহেব লিখেছেন, ‘বুখারি শরিফ পড়ার পরও তিনি প্রায় এক বছর হযরত শাইখুল ইসলামের খেদমতে এসলাহে নফস ও তাযকিয়ায়ে বাতেনের কাজে লিপ্ত ছিলেন এবং বুখারি শরিফের শরাহ লিখে তাকে দেখিয়েছেন।’ 
তদুপরি বুখারি শরিফ তরজমা কালে শাইখের রুহানী শক্তি বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ তা‘য়ালার দরবারে হযরত সদর সাহেব যেভাবে  দোয়া করেছেন, সে সম্পর্কে হযরত নিজেই লেখেনÑ ‘অতপর কয়েকবার বুখারি শরিফ ও অন্যান্য সিহাহ সিত্তা হাদিসের কিতাব দরস দেওয়ার পর যখন বাংলাদেশের অভাব মিটানোর জন্য বুখারি শরিফের বাংলা অনুবাদ করা তিনি শুরু করেন, তখন আমার খুশির আর সীমা রয়নি। আল্লাহর শোকর করেছি, মক্কা শরিফে গিয়ে হাতীমে, মাতাফে, মাকামে ইবরাহীমে দোয়া করেছি, মদিনা শরিফে রওজা পাকে দাঁড়িয়ে দোয়া করেছিÑ এই বিরাট খেদমত আল্লাহ পাক তার দ্বারা নিন, বাংলার মুসলমানদের জরুরত মিটান।’ 
অনুরূপ, দ্বিতীয় যে রুহানী ব্যক্তিত্বের আজীবন সাহচর্য পেয়ে হযরত শাইখ ধন্য হয়েছেন তিনি হলেন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.। সুলুক ও তাসাওউফের লাইনে এদেশে সর্বপেক্ষা খ্যতিমান এই যুগশ্রেষ্ঠ ওলি হযরত শাইখকে প্রাণ দিয়ে পুত্রবৎ ভালবাসতেন। 
হযরত সদর সাহেব হুজুর রহ. ও হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ন্যায় শায়খে কামেলের ৪০/৫০ বছরের সুহবত পাওয়া এ হযরত শাইখেরজন্য এক পরম সৌভাগ্য ছিল। যুগশ্রেষ্ঠ এই উভয় ওলীর রুহানিয়্যাতের সমুদ্রে শতাব্দিরও বেশি কাল যাবত অবগাহন করে শাইখেরতবিয়ত বা স্বভাব যেন শরীয়তে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। 
গৃহবন্দি অবস্থায় শাইখের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, সুলুক ও তাসাউফের কিতাবাদির সমধিক অধ্যয়ন। অধিকাংশ সময় তাকে দেখেছি, হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর অমর জীবনী (উর্দুগ্রন্থ) ‘আশরাফুস্সাওয়ানেহ’ ও হযরত থানভী রহ.-এর শ্রেষ্ঠ খলীফাদের অন্যতম বিশ্ববিখ্যাত আলেম আল্লামা সুলায়মান নদভী রহ. এর জীবনী ‘তাজকিরায়ে সুলায়মান’ পাঠ করতেন। প্রথম গ্রন্থটি অধম কর্তৃক বাংলা অনুবাদ ‘আশরাফ চরিত’ এর মুখবন্ধে হযরত শাইখ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছেনÑ ‘এ গ্রন্থটি পাক-ভারতসহ বাংলাদেশের ওলামা ও তরিকতপন্থীদের নিকট সুপরিচিত। কারণ, এ গ্রন্থখানি গতানুগতিক ভাবধারায় লিখা জীবনীগ্রন্থ বিশেষ নয়, বরং আদর্শ জীবনের বাস্তবতার একটি উজ্জ্বল চিত্র। গ্রন্থখানি পাঠেও এর অনুসরণে একজন মানুষ কামেল মুসলমান তথা আল্লাহর ওলী পর্যন্ত হতে পারেন।’ তার এ অভিমত থেকে পাঠক সত্যিই বুঝতে পারছেন তিনি এ কিতাবের মূল্যায়ন কীভাবে করেছেন। 
প্রসঙ্গত একটি অতি মূল্যবান বিষয় আরজ করছি, শাইখের গৃহবন্দি অবস্থায় তার নিকট যখন আমি হাদিসের প্রথম কিতাব  মেশকাত শরিফ পড়তে শুরু করি, তখন তিনি অধমকে উদ্দেশ্য করে বললেনÑ ‘যখন যে হাদিসটি পড়বে, তখন থেকেই তার ওপর আমল করতে শুরু করবে।’ আমি বলি, যে উস্তাদ স্নেহভরে ও কল্যাণ কামনায় ছাত্রকে এ নসিহত করতে পারেন-তার জীবনে তার বাস্তবায়ন কতখানি হয়ে থাকবে তা সহজেই অনুমেয়। প্রসঙ্গ টেনে তিনি অধমকে শুনিয়েও দেন যে, এ নসীহত তাকে তার রুহানী পিতা হযরত সদর সাহেব রহ. করেছিলেন।
আবদিয়্যাত বা আল্লাহ তা‘য়ালার দাসত্বের সর্বাপেক্ষা বড় পরিচায়ক বা প্রকাশস্থল যে নামাজ, হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর সে নামাজ এ অধম বিগত পঞ্চাশ বছর যাবৎ দেখে আসছে। বিগত বছরগুলোতে একমাত্র হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. ব্যতীত আর কারও এমন নামাজ আমি দেখিনি। নামাযে দাঁড়িয়ে গেলে মনে হয় তিনি অন্য জগতে চলে গেছেন। জীবনের শেষ দিকে হাঁটুর ব্যথাজনিত কারণে তিনি বেশির ভাগ সময় চেয়ারে বসে নামাজ পড়তেন। এর পূর্বে জীবনভর তার দাাড়িয়ে নামাজ পড়ার অবস্থা যে কেউ লক্ষ্য করে দেখেছে, বুঝতে পারবেন যে, পরম খুশু-খুযু বা হুজুরে কলবের সঙ্গে নামাজের প্রত্যেকটি রুকন সকল সুন্নাতসহ আদায় হচ্ছে। মোটকথা, শাইখের নামাজ সাহাবায়ে কেরামের নামাযের কথা স্মরণ করিয়ে দিতো। আল্লাহ তা‘য়ালা সকলকে শাইখের মতো নামাজ পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
তাসাউফের লাইনে হযরত শাইখ রহ. আল্লাহ তা‘য়ালার দাসত্ব অর্জনের সঙ্গে নিজের খুদি বা অহম ও আমিত্বকে কীরূপ মিটিয়েছেন তার দু’একটি নমুনার কথা আরজ করতে চাই: তার রুহানী পিতা ও মুরশেদ হযরত সদর সাহেব রহ. বলতেনÑ ‘সালেকের কল্ব থেকে সর্বশেষে যে রুহানী মরজ ও আত্মিক ব্য্যধি দূর হয়, তা হচ্ছে, হুব্বেজাহ অর্থাৎ সম্মান ও খ্যাতি লাভের মোহ।’ অনেক আল্লাহর পথের পথিক এ আত্মিক রোগ হতে মুক্তই হতে পারেন না। আর যদি পারেনও তবে সর্বশেষ এ থেকে নিরাময় হয়। হযরত সদর সাহেব রহ. যেমন এ কথা বলতেন, তেমনি আমরা তাকে দেখেছি এর জ্বলন্ত উদাহরণ। বলতে কি, তারই পবিত্র হাতে গড়া তার আদর্শ সাগরেদ হযরত শাইখের মধ্যেও এ মহামূল্যবান গুণটি সারা জীবন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
লালবাগ মাদরাসার শিক্ষকতার শেষের দিকে যখন আল্লাহ তা‘য়ালার পক্ষ থেকে তার হাবীব সা.-এর বড় খাদেমের জন্য শাইখুল হাদীস লকব বা উপাধিটি তার জন্য বিশেষ ও সাধারণ সকলের মুখে উচ্চারিত হতে শুরু হয়, তখনকার একদিন হযরত শাইখ বললেনÑ ‘যখন এ শব্দ দু’টি কারো মুখে নিজের জন্য শুনি, তখন প্রকম্পিত হয়ে উঠি এবং মনে মনে দুরুদ পড়তে আরম্ভ করি।’
নিজকে প্রকাশের প্রবণতা তো দূরের কথা, হযরত শাইখের মধ্যে বিনয় কোন পর্যায়ের ছিল তা শুনুন। তার অনেক বছরের ছাত্রও যদি ঘটনাক্রমে একই মাদরাসার শিক্ষক হতেন, তবুও কোথাও এ প্রসঙ্গ এলে অন্যদের সামনে তিনি তাকে নিজের ছাত্র বলে প্রকাশ না করে বলতেন, ‘তিনি আর আমি একই মাদরাসায় পড়াই।’ ঠিক তার রুহানী পিতা সদর সাহেব রহ.-এরও অবস্থা অনরূপ ছিল। সম্ভবত হিন্দুস্থান বা পাকিস্তানে হযরত শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ.-এর সঙ্গে তার সাক্ষাত হয় এবং বঙ্গদেশ থেকে আগত জেনে তিনি সদর সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘সেখানে আজিজুল হক নামে আমার এক ছেলে আছে, আপনি তাকে চিনেন কি?’ উত্তরে হযরত সদর সাহেব রহ. বলেছিলেন, ‘জি, হযরত উনি আর আমি একই মাদরাসায় শিক্ষকতা করি।’ নিজকে মিটানো আর কাকে বলে! যা ছিল রুহানী পিতার অবস্থা তাই হলো প্রিয় ছাত্রের হাল।
অধমের যতদূর মনে আছে, হযরত শাইখের হাঁটুতে আঘাত পাওয়ার পূর্বে তার হাজারও ছাত্র ও ভক্তবৃন্দ থাকা সত্ত্বেও তাদের কাউকে তার জুতা উঠাতে দিতে দেখিনি। জুতা যাতে কারো ধরার সুযোগই না হয় সে জন্য দাঁড়িয়েই পিছনের দিকে পা উঠিয়ে পায়ের এক জুতা খুলে নিজ হাতে নিয়ে ফেলতেন। অতপর দ্বিতীয় পায়ের জুতা খুলে আরেক হাতে নিয়ে মসজিদে বা মাদরাসায় ঢুকতেন। এতে জুতা উঠানোর আকাক্সিক্ষরাও নিরাশ হয়ে যেতেন।
আখলাকে বাতেন বা তরীকতের লাইনে আরেকটি মহান গুণ আমরা তার মধ্যে জীবনভর দেখেছি। তা হচ্ছে, শত্র“ থেকে     এন্তেকাম বা প্রতিশোধ গ্রহণ না করা। এমন কি তার কোনো কোনো সাগরেদ (যাদেরকে বুকে করে তিনি মানুষ করেছিলেন এবং নানাভাবে তাদের উপকার করেছিলেন, তদুপরি এলমী ময়দানে বড় বড় খেদমতের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তারাও যখন পদের মোহের কারণে শাইখের শত্র“ হয়ে গেলেন, তাদের কারও উপর তিনি সুযোগ পেয়েও প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। বরং কুরআন হাদিসের শিক্ষা অনুসারে তাদের ষড়যন্ত্র ও দুর্ব্যবহারের স্থলে ‘হাসানাত’ (সদ্ব্যবহার ও ভালোই) দ্বারা তাদের (কর্ম ও ব্যবহারের) জওয়াব দিয়েছেন। এ যুগে এ জিনিস বাস্তবিকই বিরল। তার অসাধারণ সরলতা ও পার্থিব সম্মান ও পদের প্রতি নিস্পৃহা ও নির্লিপ্ততা সকলকে শুধু মুগ্ধই করে না বরং বিস্ময়ে অভিভূত করে দেয়।
পল্টন ময়দানে স্টেডিয়াম হওয়ার পূর্বে সেখানে ঢাকার সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত হতো। দেশের রাষ্ট্র প্রধানসহ ভি,আই পিরা সে মাঠে নামাজ পড়তো। যখন রাষ্ট্রীয় উচ্চ মহল থেকে হযরত শাইখের নিকট অনুরোধ এলো উক্ত ঈদের মাঠে নামাজ পড়ানোর জন্য। তিনি বিনয়ের সঙ্গে না করে দিলেন। কিন্তু এতে সে মহল থেকে পুনরায় লোক এসে তাকে এমন ধরাই ধরেছিল যে, তিনি তখন আর রাজি না হয়ে পারেননি। সেমতে নামাজও তিনি পড়ালেন। অধম সাগরেদও সঙ্গে ছিল। নামাজের পরেই তৎকালীন রেডিও ও টিভির জনৈক কারী সাহেব আমাকে আলাদা পেয়ে হাত চেপে ধরে বলে উঠলেন, ‘হুজুর আজ কি চমৎকার নামাজই না পড়ালেন।’ আমরা অবাক হচ্ছিলাম এই ভেবে যে, এমন একটি মহামর্যাদার রাষ্ট্রীয় প্রস্তাব বা অনুরোধ কি জন্য তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন? পরবর্তী সময়ে হযরত শাইখরহ.কে জিজ্ঞাসা করা হলে বলেছিলেনÑ ‘এ ধরনের ব্যাপারে নিজের মধ্যে একটা অহমিকার ভাব আসতে পারে বলে আমি এড়ানোর চেষ্টা করেছি।’ কিন্তু আমরা জানি তিনি ‘অহম’কে এমন করেই মিটিয়েছিলেন যে, এতে তার কোনো পরিবর্তনই আসেনি। ফলে তিনি সে মাঠে বহুবছর নামাজ পড়িয়েছিলেন।
১৩.
আলেমে দীন হওয়ায় হযরত শাইখ রহ. তার স্নেহময় উস্তাদ ও রুহানী পিতা হযরত সদর সাহেব রহ. এর ন্যায় কি যে গৌরব বোধ করতেন এবং আল্লাহ তা‘য়ালার শুকরিয়া আদায় করতেন, তা বলে শেষ করার নয়। হাদিস উল্লেখ করে হযরত শাইখকে বলতে শুনেছিÑ ‘আল্লাহ তা‘য়ালা সকল মানুষেরই খায়েরখাহি করে থাকেন। কিন্তু তিনি যাকে আলেম বানিয়েছেন, বুঝতে হবে তিনি তার খায়েরখাহি বিশেষভাবে করেছেন।’ আর একখানি হাদিস দ্বারা উল্লেখিত হাদিসের ব্যাখ্যায় শাইখ বলতেন, ‘একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এস্তেঞ্জায় গেলেন। সেখানে তখন পানি পাওয়ার তেমন সম্ভাবনা ছিল না, কিন্তু উঠে বের হয়ে কাছেই একটি পাত্রে পানি পেয়ে ব্যবহার করলেন। এরপর হুজুর খুব খুশি হয়ে জানতে চাইলেন, কে পানি রেখেছে? অদূরে (খুব কমবয়স্ক) ইবনে আব্বাস রা. দাঁড়িয়েছিলেন। আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি পানি রেখেছিলাম। তখন হুজুরে পাক তাকে জড়িয়ে ধরে দো‘য়া করলেনÑ ‘হে আল্লাহ! তাকে কুরআন শিক্ষা দিও এবং দীনের বুঝ দান কর।’ 
অতপর হযরত শাইখ বলেন ‘এ হাদিস থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, দুনিয়াতে এলমে দীনের চেয়ে বড় সম্পদ আর কিছু নেই। কেননা মানুষ নিজ বংশীয় ছেলের সুখ-শান্তির জন্য সাধারণত পার্থিব ধন-সম্পদের দোয়াই করে থাকে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাচাতো ভাইয়ের জন্য কুরআন বোঝার ও দীনের গভীর এলেম হাসিলের দোয়া করলেন। আর এ দোয়ার ফলেই পরবর্তী কালে হযরত ইবনে আব্বাস রা. ‘রঈসুল মুফাসসিরীন’ ও ‘ফকীহ’ হিসাবে উম্মতের মধ্যে প্রমাণিত হন।  যোগ্য আলেম হতে পারাই যদি দীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্য যথেষ্ট না হবে, তবে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ বংশীয় ছেলের জন্য এলেমের পাশাপাশি পার্থিব ধন-দৌলতের জন্যও দোয়া করতেন। হযরত শাইখের রুহানী পিতা হযরত সদর সাহেব রহ.-এর লিখিত কিতাবে পড়েছি, কোনো ব্যক্তি যদি এখলাসের সাথে সাধনা করে এলমে দীন হাসিল করে এবং পরবর্তী জীবনে এখলাসের সাথে এলমে দীনের খেদমতে নিবেদিত প্রাণে নিজেকে নিয়োজিত করে, তবে আল্লাহ তায়ালা তার দুনিয়ার প্রয়োজনাদি অবশ্যই মিটিয়ে দিবেন। ফলে তিনি দীন ও দুনিয়া উভয় দিক দিয়ে প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদার জীবন লাভ করবেন। 
হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এলমে দীনকে দুনিয়ার সর্বোত্তম সম্পদ মনে করতেন। এ শিক্ষা ও প্রত্যয় তিনি যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নিজ রুহানী পিতা হযরত সদর সাহেব হুজুর থেকে লাভ করেছিলেন। যিনি পবিত্র কুরআন-হাদিসের আলোকে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য পরম বিনয়ী ছিলেন বটে- কিন্তু দুনিয়াদারদের সামনে এলমে দীনের মর্যাদা প্রকাশের উদ্দেশ্যে আলেম হিসাবে নিজের গৌরব প্রকাশ করতেন। আমাদের সামনেও তাকে এলমে দীনের আলোচনা করতে দেখতাম, বুক যেন তার ফুলে উঠেছে। সেই সাথে এ কথাও বলতেন, ‘দুনিয়াদারদের আর কী ধন-সম্পদ আছে। আমার তো মনে হয় যেন আমি সাত রাজার ধনের চেয়েও বড় ধন অর্জন করেছি।’
হযরত সদর সাহেব হুজুরের রুহানী সন্তান শাইখুল হাদীস রহ.-এর নিকটও এলমে দীনের মর্যাদা এমনই ছিল। তিনি এ কথাও প্রায়ই  বলে থাকতেন, ‘ যে ব্যক্তি নিজে আলেম কিন্তু নিজ ছেলেদের এলমে দীন না শিখিয়ে স্কুল কলেজে পড়ায়- তার ভাবটা যেন এরকম, নিজে ঠকেছি তো ঠকেছিই, কিন্তু ছেলেকে মাদরাসায় পড়িয়ে ঠকাতে চাই না। এমন ব্যক্তিকে বলা হয় ‘ফাসিদুল আকীদা’ (তার আকীদার মধ্যে ফাসাদ বা বিপর্যয় রয়েছে) এরপর আমাদের ওসিয়ত করেন যে, এমন আলেমের সঙ্গে আত্মীয়তা করবে নাÑ তার মেয়েকেও বিয়ে করাবে না এবং তার ছেলের নিকটও মেয়ে বিয়ে দেবে না। বরং তার চেয়ে হাজার গুণে ভালো সেই ব্যক্তি, যে আধুনিক শিক্ষিত বা দুনিয়াদার মানুষ এবং ছেলে মেয়েকেও আধুনিক লাইনে লেখা-পড়া করিয়ে ফেলেছে, কিন্তু তারা সকলে দীনদার এবং এলমে দীনের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রাখে। ছেলে আধুনিক শিক্ষিত কিন্তু সুন্নতি সুরত ও সীরত বিশিষ্ট। আর মেয়েও স্কুল কলেজে পড়–য়া, কিন্তু সাবালিকা হওয়ার পর থেকে পর্দানশীন, শরঈ পর্দা পালন করে, সহশিক্ষায় যায়নি, বরং বালিকা স্কুলে ও কলেজে পড়েছে। হযরত শাইখ বলেন, এমতাবস্থায় তাদের ছেলেকে যদি আলেম পরিবারের মেয়ে বিয়ে করাতে চায় এবং মেয়েকে আগ্রহের সঙ্গে আলেম পরিবারে (আলেম ছেলের নিকট) বিয়ে দিতে চায়, তবে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে বাধা নেই। 
১৪.
হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর গোটা পরিবার সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে সে এক আশ্চর্যকর ইতিহাসের পাতা উল্টানোর মতো। তার দুই পরিবারের গর্ভজাত মোট ৫ ছেলে ও ৮ মেয়ে। প্রথম আম্মার ওফাতের পর দ্বিতীয় আম্মাকে সংসারে পরিবারভুক্ত করেন। প্রথম আম্মার পরিচয়ে বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন প্রখ্যাত আলেম, ইসলামি চিন্তাবিদ, তাফসিরকার, গ্রন্থকার ও বাগ্মী হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম সাহেবের বড় বোন। তারা কুমিল্লার এক অতি সভ্রান্ত পরিবারের সন্তান-সন্ততি। হযরত আল্লামা যফর আহমদ উসমানী সাহেব রহ.এর সুযোগ্য সাগরেদ হযরত শাইখেরপ্রতি এতোই স্নেহময় ছিলেন যে, তাকে নিজের ছেলের মতো করে ঢাকা থেকে কুমিল্লার সফরের কষ্ট গ্রহণ করে শাইখেরশ্বশুরালয়ে তাশরিফ নিয়ে বিবাহ পড়িয়েছিলেন। হযরত শাইখ রহ. এ দুর্লভ সৌভাগ্যের জন্য আজীবন গৌরবান্বিত ছিলেন। তার এ সংসারের এক ছেলে ও চার মেয়ে। দ্বিতীয় আম্মা বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাটস্থিত উদয়পুর গ্রামের পীর বাড়ির প্রখ্যাত আলেম ও বুযুর্গ হযরত মাওলানা আজিজুর রহমান রহ.এর কনিষ্ঠ কন্যা। মুদ্দাকথা এই আম্মাও অত্যন্ত শরিফ খান্দান ও পীর বংশের মহিলা। 
উভয় আম্মারই দীনদারী, পরহেযগারী ও মেহমাননাওয়াযীর কথা হযরত শাইখুল হাদীস সাহেবের সকল আত্মীয়-স্বজনদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। দুই আম্মার বিষয়ে হযরত শাইখেরক্ষেত্রে যে জিনিসটি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে দু’সংসারের ভাইবোনদের মধ্যে কোনোপার্থক্য করার উপায় নেই। এর সবই যেন এক মায়েরই গর্ভজাত সন্তান। দু’সংসারের পুত্র-কন্যা হিসাবে না আছে শাইখেরনিকট কোনোপার্থক্য, না রয়েছে বর্তমান ছোট আম্মার কাছে কোনোতারতম্য। বড় আম্মার একমাত্র ছেলের প্রতি ছোট আম্মার ছেলেমেয়ের সকলে তাকে বড় ভাই হিসাবে কি যে মান্যতা ও শ্রদ্ধা করেন তা যারা দেখেছেন ও শুনেছেন তারাই বলতে পারবেন। অন্যদিকে বড় আম্মার ছেলে ও মেয়েরা ছোট আম্মার ছেলে মেয়েদের এক মায়েরই গর্ভজাত ছোট ভাইবোন হিসাবে স্নেহবন্ধনে রেখেছেন। বড় আম্মার মেয়েদের জামাতারা ছোট আম্মাকে আপন শাশুড়ী ভিন্ন অন্য কিছু ভাবতেই পারেন না। কারণ, জামাতাদের প্রতি তার ব্যবহার ও আতিথেয়তা আপন গর্ভজাত মেয়েদের জামাতাদের মতই। শুধু শরঈ পর্দার কারণে আম্মা তাদের সামনে আসেন না। মোটকথা, দু’সংসারের ছেলেমেয়েদের এ রকম সমতা ও ভারসাম্যতা এবং দু’পক্ষের ভাইবোনদের মধ্যে এরূপ একাত্মতা বর্তমান কালে নিঃসন্দেহে বিরল। এটি সম্ভব হতে পেরেছে হযরত শায়খেরই এলমী গভীরতা ও সংসারী দূরদর্শিতার ফসল হিসাবে। 
হযরত শাইখেরছেলেমেয়ে সকলে এমন কি নাতী-নাতনীরা পর্যন্ত তার মেধা ও প্রতিভার পরশে ধন্য হচ্ছেন। তার আওলাদরা নিঃসন্দেহে তার এলমী উত্তরাধিকার হচ্ছেন। যারা আলেম হয়ে বের হচ্ছেন তারা প্রায় সকলেই নিচের কিতাব থেকে শুরু করে দাওরায়ে হাদীসের কিতাবাদি পড়াতে পারছেন। শাইখেরসন্তান সন্তুতির মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত  এ নেআমত কারো কারো নিকট প্রথম থেকেই এক ঈর্ষণীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 
হযরত শাইখুল হাদীস রহ.এর পারিবারিক জীবনের সবিশেষ উল্লেখযোগ্য দিকটি শুধু অভিনব ও বিস্ময়করই নয়, বরং এ একটি নতুন ইতিহাস। এ ইতিহাস জেনে এবং এর যথাযথ অনুসরণ করে বিশেষভাবে তার ছাত্ররা এবং সাধারণভাবে অন্যান্য দীনদার মহল ইহকাল ও পরকালের সফলতার দিকনির্দেশনা পেতে পারেন। সংক্ষেপে তার পরিবারের ইতিহাস এই যে, তার ছেলে মেয়ে এবং তাদের উভয় দিকের নাতি নাতনী ও নাতী পুতির মোট সংখ্যা প্রায় ১৫০ জনের মত। এবং তার নিজের ২ সংসার এবং ছেলে ও নাতিদের বউ এবং মেয়েদের ও নাতনীদের জামাতাসহ সর্বমোট সংখ্যা ১৭০ এর মত। তিনি প্রথম ২ মেয়েকে আরবি, উর্দু ও বাংলা শিক্ষা দেন। অতঃপর তৃতীয় মেয়েকে পরীক্ষা মূলকভাবে হেফজ পড়তে দেন। দেখা গেল মেয়েটি ছেলেদের চেয়েও অগ্রগতিতে কালামে পাকের হেফজ সমাপ্ত করে এবং সফলভাবে হেফজ রক্ষা করতে থাকে। এরপর থেকেই তিনি তার ছেলে হোক, মেয়ে হোক সকলকে হেফজে দেন এবং তা সমাপ্ত করার পর ছেলেদেরকে মাদরাসায় কিতাবী লাইনে আলেম বানাতে থাকেন এবং মেয়েদের উর্দু ও বাংলার মাধ্যমে দীনী শিক্ষা দিতে থাকেন। আর পবিত্র রমজান মাসের আগমনে তার ঘরে মেয়েদের খতমে তারাবীহ এবং বড় ছেলেরা মসজিদে বা ঘরে জামাত করে তারাবীহ পড়ায়। আর মেয়ে ও নাতনীদের কেউ বাড়িতে কেউ শ্বশুরালয়ে আলাদাভাবে খতমে তারাবীহ পড়ছেন। সে এক আজীব ও হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য। 
মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে শাইখেরদৃষ্টিভঙ্গি এই যে, একটি মেয়ে হাফেজা হলে তাকে হেফজ রক্ষার জন্য সারা জীবন যে পরিমাণ পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে এবং সেই সাথে বাংলা বা উর্দু ভাষায় দীনী জরুরী এলম শিখে আমল করতে থাকলে এটাই তার জন্য বড় দৌলত। তদুপরি সে যদি নিতান্তই কিতাবী লাইনে মাদরাসায় পড়ে তবে তার জন্য সর্বশেষ অর্জন এই হওয়া উচিত যে, সে যেন পবিত্র কুরআনের তরজমা সহীহ শুদ্ধভাবে করতে পারে এবং মেশকাত শরিফ সহীহ করে পড়ে বুঝতে পারে। উস্তাদদেরও এর প্রতি নজর দেওয়ার দরকার। বরকত স্বরূপ তাফসীরের কিতাব ‘জালালাইন’ ও হাদীসের কিতাব বুখারি শরিফ ও তিরমিযী শরিফ তাদের পড়ানো যেতে পারে। তবে শর্ত এই যে, মেয়েরা বোর্ডিং এ থাকবে না, বরং পিতা-মাতার নজরে নিজ বাড়িতে থাকবে। কেননা, দশ বাড়ির দশ মেয়ে একত্রে থাকলেই আজে বাজে গল্প-গুজব করা, নাটক-উপন্যাস পড়া ও বাজে কাজের সুযোগ পায়।  প্রসঙ্গত এ দেশের শীর্ষস্থানীয় উলমায়ে কেরাম ও বেফাক বোর্ডের কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করি, তারা যেন প্রজ্ঞা ও চিন্তার আলোকে মেয়েদের জন্য একটি বাস্তবধর্মী নেসাব তৈরি করেন। 
মাশাআল্লাহ, বর্তমানে শাইখের আওলাদের মধ্যে হাফেজ ও হাফেজার সংখ্যা ৭৫ জনের মত। আধা হাফেজ ও হেফজের সবকে রয়েছে বেশ কয়েকজন শিশু। অর্থাৎ তিনি তার সন্তান সন্তুতির সকলকে হাফেজ বা হাফেজা বানাতে প্রত্যেকের পিতামাতাকে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ করে গেছেন। ফলে তার আওলাদদের মধ্যে ছেলেদের তো কথাই নেই, মেয়েদের বা নাতনীদের সংসারে অর্থাৎ স্বামীদের বাড়িতেও তাদের সন্তানদের হাফেজ হাফেজা ও আলেম হওয়ার পথ তৈরি হয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ। হযরত শাইখেরছেলেমেয়ে যে কারো গর্ভে যে সন্তানই জন্ম নিবে, তাকে প্রথমে আল্লাহ চাহেন তো হাফেজ বা হাফেজা বানাতে হবে। তাই দেখা যায়, শাইখের আওলাদের মধ্যকার মেয়েকে যিনি বিয়ে করেন তিনি বস্তুতই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে গেলেন, তার ভবিষ্যত সন্তানকে স্কুলে না দিয়ে হেফজ ও দীনী লাইনে পড়াবেন। 
হযরত শাইখের জীবদ্দশায় তার অন্যতম ওসিয়ত এই যে, ‘আমার বর্তমান আওলাদের যে কারও ঘরে ভবিষ্যতে ছেলে পয়দা হোক বা মেয়ে, তাকে অবশ্যই হাফেজ বা হাফেজা বানাবে। তারপর ছেলেকে আলেম বানাবে ও মেয়েকে দীনী কিতাবাদি পড়াবে। সম্ভব হলে আরবি শিক্ষা দিয়ে আলেমা বানাবে। কিন্তু কাখনও কাউকে স্কুল-কলেজে পড়াবে না।’ কারণ, একে তো বর্তমান কালে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি পড়িয়ে ছেলেমেয়ের ঈমান-আকীদা ও আমলাদি ঠিক রাখাই মুশকিল। দ্বিতীয়ত পবিত্র কুরআন-হাদীস ওহীর এলেম হিসাবে  এর চেয়ে বড় সম্পদ দুনিয়াতে আর কিছু নেই। 
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রতি বছর দু’এক বার হযরত শাইখ তার আওলাদের নিয়ে বসতেন এবং এ ওসিয়ত নবায়ন করতেন। বিশেষত প্রতি রমজান মাসে তার আওলাদের ঘরে ঘরে খতমে তারাবীহ শেষে ২৯ শে রমযানের রাতে তাকে কেন্দ্র করে আমরা সকলে একত্রিত হতাম। পবিত্র রমযানে তার মেয়ে আওলাদরা তারাবীর নামাযে সাধারণত দু’খতম এমনকি কেউ কেউ তিন খতমও করে থাকেন। এর জন্য পড়তে হয় কত খতম তা সহজেই অনুমেয়। তার আওলাদদের মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, রমযানের শেষ দশকের রাতগুলি তারা তেলাওয়াত, সালাতুত তসবীহ,তাহাজ্জুদ, যিকির-আযকারসহ খতমের পর খতম পড়ে  রাত্রি জাগরণ করে থাকে। এভাবে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ শ রমযান সারারাত তারা ছোট বড়  ছেলেমেয়ে সকলেই ইবাদত বন্দেগী করে কাটান। যাতে আল্লাহ তা‘য়ালার রহমতে শবে কদর পাওয়ার সৌভাগ্য সকলেরই হাসিল হয়। সে রাতগুলিতে তাদের শিশুরা পর্যন্ত আনন্দ খুশিতে পিতা-মাতা ও বড় ভাইবোনদের সঙ্গে সজাগ থাকে। আনন্দের আতিশয্যে তার ছোট ছোট নাতী-নাতনীরা বলত, আজকে রাতে আমরা দাদার, নানার, কেউ বলত, বড় আব্বার ওয়াজ শুনব, দোয়া করব ও মিষ্টি খাব। 
এমনি করে দেখতে দেখতে ২৯ শে রাত এসে যেত এবং সেই আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। পুরুষ ও ছেলেরা যথারীতি এশার নামাজ মসজিদে জামাতে আদায় করে বাসায় এসে যেত এবং হযরত শায়েখকে নিয়ে তারাবীর নামাযে দাঁড়িয়ে যেত। মাইকের ব্যবস্থা থাকত এবং ডান ও বাম দিকের ঘরগুলিতে শ্রদ্ধেয়া আম্মা তার মেয়েদের ও নাতনী-পুতনীদেরসহ তারবির জামাতে শরীক হতেন। পারিবারিক খতমের এই শেষ রাতে হযরত শায়েখের ছেলে ও নাতীদের মধ্য থেকে কয়েকজন দুই দুই রাকাত করে (ইমামতিতে) পড়ত। আর তিনি শুনতে থাকতেন, কে কেমন পড়ে এবং সালামের পরই তেলাওয়াত ও নামাযের ধরণ সম্পর্কে শফকতপূর্ণ নসীহত করতেন। সেই সঙ্গে মেয়ে ও নাতনীদের খবর নেন, কে কত খতম পড়েছে পবিত্র রমজানে। মহিলাদের মধ্যে যারা হাফেজা নন, তাদেরও কেউ কেউ রমজান মাসে দশ খতম কুরআন পড়েছেন বলে শোনা গেছে। নামাজ বাদ তাকে মধ্যবর্তী এমন একটি স্থানে বসানো হত, যেখানে তাকে পুরুষ ও মহিলারা সকলেই দেখতে পেতেন। বলাই বাহুল্য, শুধু তারই পরিবারভুক্ত সদস্যদের নিয়ে এই সমাবেশ হত বলে সবারই মাহরাম ছিলেন তিনি। অবশ্য আওলাদের মধ্যে মাহরাম ও গাইরে মাহরামের ব্যাপার থাকত বলে তাদের বসার স্থান পূর্ব থেকেই এরূপ করা হত যেন কোনোক্রমেই গাইরে মাহরামদের কেউ কাউকে দেখতে না পায়। মোটকথা, দোয়ার এ অনুষ্ঠানে ব্যবস্থাপনাটিই এরূপ ছিল যে, সবার জন্য এ এক শিক্ষনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর পর শাইখুল হাদীস সাহেব রহ. সংক্ষিপ্ত বয়ান করতেন। তার পূর্বোক্ত ওসিয়তের নবায়ন করতেন এবং তার পারিবারিক এ দৌলতকে ধরে রাখার জন্য নসীহত করতেন। 
সর্বপরি আল্লাহ তা‘য়ালা যে একমাত্র তারই অনুগ্রহ ও রহমতে এ বিরল নেয়ামত তাদের দান করেছেন, এ জন্য সর্বদা তার শুকরিয়া আদায়ের জন্য এবং নিজেদের কোনোত্র“টি অর্থাৎ বড়াই, অহমিকা বা আত্মখুশির কারণে এ নেয়ামত ছিনিয়ে নেয়া না হয় সে জন্য তার প্রতি নিবেদিত প্রাণ হয়ে থাকা ও আজীবন সেজদাবনত হয়ে থাকার জন্য উপদেশ দান করতেন। এ সময় থেকেই হযরত শাইখ রহ. ক্রমান্বয়ে ভাবাবেগে অশ্র“সিক্ত হয়ে যেতেন। সঙ্গে সঙ্গে তার আওলাদেরও এরূপ অবস্থা দেখা যেত। তার পর রাহমানুর রাহীমের হুজুরে মুনাজাতের জন্য হাত উঠানোর সঙ্গে সঙ্গে আওলাদদের সকলেই রোনা-যারী শুরু করে দিত। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। হযরত শাখের উল্লেখযোগ্য ও হৃদয়স্পর্শী দোয়ার ধরনখাণি সংক্ষেপে এরূপ হত : আয় আল্লাহ! তুমি রহমান, তুমি রাহিম। তুমি তেমারই কৃপা ও অনুগ্রহে এই নেয়ামত  অর্থাৎ দীনদারী ও কালামে পাকের হেফজ ও দীনী এলম হাসিলের সৌভাগ্য] আমাদের দান করেছ। এতে আমাদের কোনই কৃতিত্ব নেই। বরং আমাদের ধারণা চিন্তার বাইরে তুমি নিজ পক্ষথেকে আমাদের তুমি তোমারই খাস রহমতে যেমন ফলেফুলে সজ্জিত এ বাগান আমাকে দান করেছ তেমনি এর হেফাজতের জন্যও আমরা তোমারই দয়া ও রহমতের মুখাপেক্ষী। আয় আল্লাহ! তুমি তোমার নিজ রহমতে ও তোমার হাবীবের তেফায়েলে আমাদের এ নেয়ামত কেয়ামত কাল পযর্ন্ত দায়েম ও কায়েম রাখ।’ এ সময় হযরতে শাইখও তার আওলদের হৃদয়স্পর্শী কান্নায় ও রোনাযারীতে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠত। 
উল্লেখ্য যে, তার উক্ত হেফ্জ বাগানের ফল ওফাতের পর থেকেই তিনি ভোগ করতে শুরু করেছেন। তার ছওয়াব রেসানীর জন্য তার হাফেজ আওলাদের মধ্য থেকে দৈনিক এক খতম ও মেয়েদের পক্ষ থেকে এক খতম মোট দু‘খতমের ছওয়াব তার রূহের মাগফিরাতের জন্য রোজানা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ এই সিলসিলা চলতে থাকবে এবং পরবর্তী আওলাদের মধ্যে হাফেজ হাফেজার সংখ্যা বাড়তে থাকলে শাইখ রহ.-এর ছওয়াবের ভাগও বাড়তে থাকবে। আল্লাহ তা‘য়ালা কবুল করুন।  
ওফাতের পূর্বে অশীতিপর বৃদ্ধ হয়েও ভোর রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আর শয়ন করতেন না। বাদ ফজর থেকে জোহর পর্যন্ত একাধারে ৪/৫ টি মাদরাসায় বুখারি শরিফের সবক পড়াতে পারতেন। আমরা ভেবে বিস্ময়াভিভূত হতাম, কোথা থেকে তিনি এ শক্তি ও কর্মতৎপরতা পাচ্ছেন! কিন্তু যখন গভীরভাবে চিন্তা করি, তখন বুঝি তার উপরোল্লিখিত উস্তাদদের সুদৃষ্টি ও দোয়ার বরকতে আল্লাহ তায়ালা তার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশ্রেষ্ঠ হাদীছ গ্রন্থ বুখারি শরিফের খেদমতকে তার হাবীবের সর্বশ্রেষ্ঠ খাদেমকে দিয়ে বাংলার বুকে সুবিস্তৃত করে দেওয়ার জন্য রূহানী শক্তির সঙ্গে জিসমানী বা দৈহিক শক্তিও দিচ্ছেন। আয় আল্লাহ! তোমার হাবীবের সর্বশ্রেষ্ঠ এই খাদেমের স্থান জান্নাতুল ফেরদাউসে দান করুন আমিন  
হযরত শাইখুল হাদীস রহ. তার আওলাদদের প্রতিটি সদস্যের দীনী উন্নতির উদ্দেশ্যে একটি বিরল ও অপূর্ব ঐতিহ্য রেখে গেছেন। তা হচ্ছে, তার আওলাদের প্রত্যেক পরিবার থেকে পুরুষ সদস্যরা মাসে একবার রাতে শাইখের বাড়িতেই মিলিত হয় এবং তারা সকলে প্রথমত নিজেদের আত্ম সমালোচনা এবং দ্বিতীয়ত তাদের সংশ্লিষ্ট পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের আলোচনা করে থাকে। তারা সার্বিক দীনী দিকগুলির আলোচনা করে নির্ধারণ করে, কার মধ্যে কতখানি দীনী উন্নতি হওয়া প্রয়োজন এবং এ পর্যন্ত তার কতটুকু হয়েছে এবং আর কতখানি হওয়া দরকার। সে মতো আম্মাজানসহ সকল সদস্য তাদের ছোটদের উল্লিখিত যার যার রিপোর্ট জানিয়ে দেন। এবং পরবর্তী মাসব্যাপি দেখা হয়, তার মধ্যে কতটুকু উন্নতি হচ্ছে। পরবর্তী মাসের মাহফিলে সে সব নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং তা আমলে আনার জন্য প্রত্যেককে নোটিশ দেওয়া হয়। তারা সম্মিলিতভাবে ঠিক করে, সামনে সকল সদস্যের বাতেনী আখলাক গঠনে তারা সচেষ্ট হবে। হযরত শাইখ রহ.-এর রেখে যাওয়া এ ঐতিহ্যও অদূর ভবিষ্যতে ফুলেফলে সুশোভিত হোক। সে জন্য সকল পাঠকের দোয়াও যেমন কাম্য, তাদের নিজেদের মধ্যেও এ ধরনের প্রচেষ্ট ও সাধনাও কাম্য। আল্লাহ তা‘য়ালা কবুল করুন। আমিন
 
লেখক : বড়জামাতা, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.

Powered by Create your own unique website with customizable templates.