• প্রথম পাতা
  • আরবী সাহিত্যে শাইখুল হাদিস সেমিনার
    • হযরত পাহাড়পুরী হুজুর দা: বা:
    • শাইখুল হাদিস আল্লামা আশরাফ আলী
    • মুফতি আব্দুল মালেক দা: বা:
    • মাওলানা আব্দুল মতিন বিন হুসাইন
    • মুফতি মাহফুজুল হক দা:বা:
    • মাওলানা শহিদুল্লাহ ফজলুল বারী ও উবায়দুর র
    • মাওলানা আব্দুল জব্বার দা: বা:
    • ড: শামসুল হক সিদ্দিকি দা:বা:
    • মাওলানা যায়নুল আবেদীন
  • শাইখুল হাদিস কনফারেন্স
    • উলামা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য প্রö
    • উলামা ওরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা-২
    • উলামা ওরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা-৩
    • হাফেজ উমর রহ:
    • শাইখূল হাদিস মামুনুল হকের ভাষণ
    • তারানা- সাঈদ আহমাদ
  • রাহমানিয়া ছাত্র কাফেলা স্মৃতি আলোচনা
    • স্মৃতি আলোচনায় মাওলানা মামুনুল হক
    • স্মৃতি আলোচনায় মুফতি সাঈদ আহমাদ
  • জীবনের বাঁকে বাঁকে
    • আব্বার শাসন ও সযত্ন অনুশীলন
    • আমার আম্মার কথা
    • লেখাপড়ার সুচনা
    • হযরত শামছুল হক ফরিদপুরীর সাহচার্য আমার জী
    • আমার তালিম ও তরবিয়াতে হযরত ফরিদপুরির দরদ ও &#
    • হযরত রফিক আহমাদ কাশ্মিরী রহ. এর কথা
    • হাদিসে রাসুল সা. এর প্রথম পরশ
    • দাড়িয়ে তব দুয়ার মাঝে
    • অধমের মাথায় হযরত থানভীর পাগড়ি
    • হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.
    • হুজুরের স্নেহের একটি নমুনা
  • সরাসরি সম্প্রচার
  • প্রধান কলাম সমূহ
    • বিদায় বাংলার শাইখুল হাদিস
    • উলামায়ে দেওবন্দের পতাকাবাহী
    • এক আল্লাহ ছাড়া কারো ভয় ছিল না
    • শাইখুল হাদিসকে যেমন দেখেছি
    • শাইখুল হাদিস রহ. স্মরণে
    • আমার জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক
    • হেফাজতে দ্বীনের জন্য শায়েখের আদর্শ গ্রহন 
    • শাইখুল হাদিসের স্মৃতিকথা, তাযকিরাতুল আজিö
    • শাইখুল হাদিস অনুদিত বুখারী শরীফ
    • জীবনের বেলাভূমিতে প্রিয়তম শাইখুল হাদিস
    • নবী প্রেমের কবি
  • জীবনউপলদ্ধি
    • তার জীবন আমাদের উপমা
    • ঘরে বাইরে শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক র
    • আদর্শ শিক্ষক যার শ্রেষ্ঠ পরিচয়
    • শাইখুল হাদিসের জীবনী পাঠ্য করা হোক
    • মওতুল আলেমি মওতুল আলমি
    • আজ আমি এতিম
    • অনন্য শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক
    • তিনি আমাদের বুখারীর ইমাম
    • আললামা
    • গন্তব্যে আমৃত্যু অবিচল
    • তিনি কোটি মানুষের প্রেরনা
    • দ্বীনের সফল মহানায়ক
  • গবেষনা
    • হকের উপর অটল এক ব্যক্তিত্ব
    • অসাধারন গুনাবলীর অপূর্ব সমাহার
    • হাদিস চর্চায় কালজয়ী অবদান
    • আমার দেখা শাইখুল হাদিস
    • তিনি কেন অসাধারণ
    • ঈমানদীপ্ত এক বীরের গল্প
    • রহমানিয়া ও শাইখুল হাদিস রহ.
    • আপনি ঘুমাতে পারেন না
    • রাজনীতিবিদ শাইখুল হাদিস
    • বাবরী মসজিদ লংমার্চ
  • অনুভূতি
    • আমার অনুভূতি
    • দীনের দরদী খাদেম
    • তার সাথে আমার জীবনাচার
    • শাইখুল হাদিসকে যেমন দেখেছি
    • হাদিসের দিকপাল
    • মহানুভবতার উজ্জল দৃষ্টান্ত
    • ইলম ও আমলের প্রানময় বটবৃক্ষ
    • স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
    • শাইখুল কুরআন
    • আদর সোহাগে গড়েছেন এক আদর্শ পরিবার
    • যে রত্ন আজ হারিয়ে খুজিঁ
  • স্মৃতি আলোচনা
    • প্রিয় রাহবারের শবযাত্রার মিছিলে ৩০ ঘন্টা
    • কতো স্মৃতি কতো কথা
    • সুযোগ পেলেই তার কপালে চুমু খেতাম
    • স্মৃতির পাতায় শাইখুল হাদিস
    • যার জিকিরে গুন্ঞ্জরিত মাদরাসা
    • শাইখুল হাদিস জিন্দাবাদ নয়
    • স্মৃতিগুলো জেগে থাকে মনে
    • স্মৃতি ও স্বপ্ন
    • স্মৃতিতে শাইখুল হাদিস
    • স্মৃতিগুলো এলোমেলো
    • মনের মুকুরে
    • সবই আছে শুধু নানাজি নেই
    • স্মৃতির পাতায় শাইখুল হাদিস
  • একান্ত সাক্ষাতকারে শাইখুল হাদিস
  • শাইখুল হাদিসের বৈচিত্রময় জীবন-সাধনা
    • বংশ ও পূর্ব পুরুষ
    • জন্ম ও শৈশব কাল
    • শিক্ষা জীবন
    • উল্লেখযোগ্য শিক্ষকবৃন্দ
    • শিক্ষকতা
    • রচনা ও সংকলন
  • স্মৃতি তারানা
    • তুমি সত্য ন্যায়ের বাতি
    • এতিম হলো দেশ
    • তার বিদায়ে কেঁদেছে মানুষ
  • ছবি গ্যালারী


ইন্তেকালের পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহের বিশদবিবরণ 
জীবনের বেলাভূমিতে প্রিয়তম শাইখুল হাদীস রহ.
কামরুল হাসান রাহমানী

হযরত শাইখুল হাদীস রহ. কে যারা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তারা যানেন যে, শারীরিকভাবে হুজুর সবসময় মোটামুটি সুস্থ ছিলেন। শেষ জীবনে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার বাইরে রোগে- শোকে শয্যাশায়ী হতে খুব কমই দেখেছি। দরসে হাদীসের সুমহান দায়িত্ব পালনে অহর্নিশ ছুটে চলা, ভণ্ড-বাতিল আর মুখোশধারিদের মুখোশ উন্মোচনে উত্তপ্ত রাজপথ কাঁপিয়ে তোলা, পথহারা বনি আদমকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে শহর-বন্দর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত চষে বেড়ানো, আবার কখনো বা হাদিসের রতœভাণ্ডার  লেখনীর মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে নির্জন টেবিলে একান্ত ডুবে থাকার মতো কর্মমুখর শাইখুল হাদীসকেই আমরা দেখে অভ্যস্ত। কর্মময় জীবন কামনার যে দোয়া হাদীসে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে হযরতের জীবন ছিল তারই বাস্তব নমুনা।
আশি পেরোনো শাইখুল হাদীসকে আমরা দেখেছি দুরন্ত কিশোরের উদ্যমে ছুটে চলতে। একপর্যায় তিনি হুইল চেয়ারের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন। বলা যায় জীবনের শেষ দশকে তার একান্ত আপনজনদের তালিকায় হুইল চেয়ারও স্থান দখল করে নেয়। চলাচলের ধরণে পরিবর্তন এলেও কর্মের ধরণে তেমন কোনো পরিবর্তন ছিল না। এই আবস্থা বিদ্যমান ছিল ২০১০ সাল অর্থাৎ ১৪৩১ হি. রমজানের পূর্ব পর্যন্ত। ওই বছর রমজানের পর থেকে সকল প্রকার দরস-তাদরীস বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে হযরত ‘লাজিমুল ফিরাশ’ তথা পূর্ণ শয্যাশায়ী হন। যে কর্মতৎপর পা দুটি উম্মতের জন্য সদা সচল থাকতো, যে হাত দুটি লেখালেখিতে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতো, যে মুখটি হাদিসের তাকরিরে সর্বদা মুখর থাকতো, হঠাৎ যেন সব নিরব-নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এ যেন খোদার পক্ষ থেকে তার এক প্রিয় বান্দাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হলো। দরদি এ বান্দা নিজ থেকে কিছুতেই অবসর নিতে রাজি নন। তাই এ ব্যবস্থা আর কি! তখন থেকে ইন্তেকালের পূর্বপর্যন্ত আমাদের মাঝে হুজুরের উপস্থিতি রহমত ও বরকতের ওছিলা রূপে পরিগণিত ছিল। এই দু’বছরের প্রথম দেড়বছর হুজুরের অবস্থা ছিল অনেকটা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো। খাওয়ার সময় খেতেন, কখনোসখনো নামাজ কালাম পড়তেন, বাকি সময় ঘুম বা জিকিরে লিপ্ত থাকতেন। এ অবস্থায় হুজুরের সাথে আমার সর্বশেষ সাক্ষাৎ ছিল বিগত ০১/০৩/১২ ইং রোজ বৃহস্পতিবার। মনে মনে সেদিন শঙ্কিত ছিলাম,  কোনো কষ্টদায়ক দৃশ্য দেখতে হয় কিনা। হুজুরের বাসার নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই হুজুরের ছোট সাহেবজাদা মাওলানা মাসরুরুল হকের সঙ্গে দেখা। সে এবং মাওলানা এহসানুল হক আমাকে হুজুরের রুমে  পৌঁছে দিল। একটি অপার্থিব পরিবেশ সেখানে বিরাজমান। রুমের কোনায় কোনায় একটি মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। আমার মধ্যে খানিকটা অস্বাভাবিকতা। পূর্ণ সতর্কতার সাথে খাটের এক কোণে গিয়ে বসেছিলাম। চোখ দুটি বন্ধ। ঠোঁট দুটি অবিরাম নড়ে যাচ্ছে। কান পেতে শুনলাম ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ জিকির চলছে। আমি আলতো করে হুজুরের হাতটা নিজের হাতে নিলাম। ইত্যবসরে এহসান আবার ফিরে এসে নানাজি নানাজী বলে ডাকতে আরম্ভ করলো। হুজুর চোখ মেলে তাকালেন। এহসানকে হুজুর যেন চিনতে পেরেছেন মনে হলো। আমি দুআর দরখাস্ত জানালাম। হুজুর মুখ নেড়ে কিছু একটা বললেন। আমার মনে হলো, হুজুর ইনশাআল্লাহ বললেন।  এহসানও তাই বললো। আমি পা দুটিতে কিছুক্ষণ হাত  বোলালাম। রক্ত চলাচলের সুবিধার্থে হালকা কম্পমান একটি যান্ত্রিক বিছানায় হুজুর শোয়া ছিলেন। হুজুরকে খুবই সুস্থ-শান্ত মনে হচ্ছিলো। বিস্তারিত জেনে এবং চোখে দেখে মনে হলো, চলাচলে অক্ষম শারীরিকভাবে পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ। না আছে শারীরিক জ্বালা-যন্ত্রণা, না আছে অশান্তি-অস্থিরতা। ঠিক যেন দুগ্ধপায়ী শিশু। ক্ষুধা লাগলে খায়, বাকি সময় পরম আনন্দে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়।  সারাটি জীবন শিশুসুলভ যে সরলতা হুজুরকে ছায়া দিয়ে রাখতো। শাইখুল হাদীস আজ যেন আবার সেই শিশুতে রূপ নিয়েছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, এই বিশ্রাম হুজুরের একান্ত পাওনা ছিল। সারাটি জীবন কর্মব্যস্ততার কারণে বিশ্রাম নেওয়ার এতটুকু সময়ও তিনি পাননি। তাই আল্লাহ এই অফুরন্ত অবসর ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছেন। 
শেষ সাক্ষাৎ   
মনে হয় শিরোনামটি সঠিক হলো না, কারণ সাক্ষাৎ শব্দের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার থাকে। ব্যাপারটি ছিল শেষ দেখা। ৩১ জুলাই মঙ্গলবার। হযরতের হৃদয়ের খুন পানি করে তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান জামিয়া রাহমানিয়া থেকে আজিমপুরের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সঙ্গে জামিয়ার আরো দুই উস্তাদ ভ্রাতৃপ্রতিম মুফতি তাওহীদুল ইসলাম ও মুফতি নূরুজ্জামান সাহেব। যানজট এড়িয়ে দ্রুত পৌঁছার জন্য শহুরে পরিচিত রাস্তা বাদ দিয়ে বেড়িবাঁধ হয়ে আজিমপুর রওনা হলাম। এই পরিকল্পনা কোনো কাজেই আসলো না। যথারীতি জ্যামের কবলে পড়লাম। দশ মিনিটের পথ ঘণ্টায়ও শেষ হয় না। যেখানে পরিকল্পনা ছিল ৯ টার মধ্যে মাদরাসায় ফিরে আসার, সেখানে আজিমপুর পৌঁছতেই সাড়ে ১০ দশটার ওপরে বেজে গেল, কিন্তু আমার বেজে গেল ১২ টারও বেশি। কারণ আমার মাতৃতুল্য শাশুড়ি আম্মা আমার অপেক্ষায় মোহাম্মাদপুর এসে অপেক্ষমান। সঙ্গের হুজুরদ্বয় বারবার অনুরোধ করছিলেন ফিরে গিয়ে শাশুড়িকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। অন্য যেকোনো সময় হলে বলা ছাড়াই আমি এটা করতাম। কিন্তু সেদিন আমার মন বলছিল, আজ দেখতে না পারলে জীবদ্দশায় আর তুমি হুজুরের সাক্ষাৎ পাবে না। তাই আমি শক্ত হলাম, অনড় হলাম- যতো দেরিই হোক হুজুরকে দেখেই ফিরবো।
বাসার সামনে পৌঁছতেই দেখা হলো শায়খুল হাদীসের গর্বের ধন, যোগ্য উত্তরসূরি, জামিয়া রাহমানিয়ার  দক্ষ কাণ্ডারিÑ মাওলানা মাহফুজুল হক সাহেবের সঙ্গে। প্রস্তুতি নিয়ে বাইরে কোথাও যাচ্ছিলেন, আমাদের দেখে আবার ভেতরে গেলেন এবং আরেক শাইখরতœ মাওলানা মামুনুল হকের হাতে আমাদের সোপর্দ করে আবার বেরিয়ে গেলেন। হুজুরকে তখন খানা খাওয়ানো হচ্ছিল। তাই আরও খানিকটা অপেক্ষা করতে হলো। মামুন ভাই সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে আমাদের দেখার ব্যবস্থা করলেন। আমরা প্রবেশ করলাম ওই রুমে, যেখানে শুয়ে আছেন শত বছরের জীবন্ত ইতিহাস, দীন ও মিল্লাতের অতন্দ্রপ্রহরী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জীবন্ত বুখারি, শাইখুল মাশাইখ আল্লামা আজিজুল হক। হাটা-চলায়, ঘরে-বাইরে সর্বদাই যে ঠোঁট দুটিকে আল্লাহর জিকিরে সদা ব্যস্ত দেখতাম, সে ঠোঁট দুটিকে বড় নীরব মনে হলো। আমার ভেতরটা প্রচণ্ড কেঁপে উঠলো। ঠোঁট দুটির মতো না জানি হুজুরও কখন নিরব হয়ে যান। চোখ দুটি বন্ধ। একটি খাটে গুঁটিসুটি শুয়ে আছেন সমকালীন ইতিহাসের মহান নকিব। রুমের এই নিরবতা বুকের পাঁজর ভাঙা বেদনা সৃষ্টি করল। তাই দ্রুতই বেরিয়ে এলাম। মুহাম্মাদপুর ফিরতে ফিরতে প্রায় একটা বেজে গেল। নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করে হুজুরকে দেখতে যাওয়ার বিষয়টি শাশুড়ির কাছে পেশ করলাম। তিনি ব্যাপারটিকে খুবই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলেন এবং বললেন, হুজুরকে না দেখে চলে আসলেই বরং অন্যায় হতো। এই দেখে আসার ৭ দিন পর ৮ আগস্ট হুজুর এন্তেকাল করেন।
১৭ জুলাই মঙ্গলবার ২০১২ ইং 
১৭ জুলাই মঙ্গলবার ২০১২ ইং তারিখে হযরত হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাথে সাথে বারডেমে ভর্তি করা হয়। ৯ দিন হাসপাতালে থাকার পর ২৬ জুলাই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় খাদ্য গ্রহণে সমস্যা দেখা দেওয়ায় রাইছ টিউবের সাহায্যে খাওয়ানো শুরু করা হয়। হাসপাতালে আনা-নেওয়ার এই দিনগুলিতে হযরতের অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং সারাদেশ থেকে অসংখ্য ফোন আমাদের কাছে আসতে থাকে। হুজুরের হাজার হাজার ছাত্র, ছাত্রের ছাত্র, শুভাকাক্সিক্ষ-শুভানুধ্যায়ীরা প্রতিনিয়ত জানতে চান হযরতের শারীরিক অবস্থা। এ সময় মাঝে মাঝে এ খবরও ছড়িয়ে পড়ে যে, হযরত আর দুনিয়াতে নেই। ৬ আগস্ট ১৭ রমজান অবস্থা বেশি অবনতির দিকে চলে যায়। তখন পরিবারের লোকেরাও বিরাট ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য নিজেদেরকে শক্ত করতে আরম্ভ করেন। ১৮ রমজান সারারাত কাটে আল্লাহর কাছে রুনাজারি আর দোয়া ও তেলাওয়াতের মাধ্যমে। ১৯ রমজান অবস্থার খানিকটা উন্নতি হয়। তখন রাতজাগা স্বজনেরা গোসল ও বিশ্রামের জন্য একটু অন্যমনস্ক হন। হুজুর যেন সকলকে ফাঁকি দিতে এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। অসংখ্য কলিজার টুকরো সন্তানসন্তুতি আর আপনজনদের চাতকদৃষ্টির সতর্ক পাহারাকে ফাঁকি দিতে তিনি যেন ব্যর্থ হচ্ছিলেন। পালানোর এইতো সুযোগ-মহাসুযোগ। মহানপ্রভুর সকাশে হাজির হতে ফিরিস্তা আর হূর-পরিরা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যে ডাক উপেক্ষা করা যায় না, ত্বরও সয় না। মহান প্রভুকে পাওয়ার জন্য আজ তিনি উতলা-পাগলপারা। আজীবন লালিত সকল নিয়মনীতি তিনি ভুলে গেলেন, একেবারেই ভুলে গেলেন। আমাদের চির চেনা পরম পরোপকারী শাইখুল হাদীস আজ যেন বড়ই স্বার্থপর। কোমল হৃদয়ের প্রবাদতুল্য আজিজুল হক আজ বড়ই হৃদয়হীন-পাষাণ। কোটি হৃদয়ের শত আকুতি, কোটি নয়নের অশ্র“-বারি আজ বড়ই মূল্যহীন। তিনি আজ যেন অন্যকেউ, একেবারেই অন্যকেউ। দেশ-বিদেশের লক্ষ-কোটি আপনজনকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি রওনা হলেন। চতুর্থ ছাহেবজাদা মাওলানা মামুনুল হক ভাই হুজুরের কাছেই ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন হুজুরের শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক। প্রিয় বাবার প্রিয় সন্তান চকিত হলেন, বিচলিত হলেন, বেচাইন হলেন। সাথে সাথে জমজমের পানি তুলে দিলেন হযরতের মুখে। অতি সাধারণ আতিথিয়তা গ্রহণে প্রসিদ্ধ শাইখুল হাদীস আজ বড়ই অভিমানী। সময় তখন দুপুর ১২ টা ৪০ মি.। পরিসমাপ্তি ঘটল শতাব্দিব্যাপী এক ঘটনাবহুল ইতিহাসের। আলোকহীন হলো মসনদে হাদিসের উজ্জ্বল আকাশের দেদীপ্যমান সূর্য। আমি জানি না প্রিয় সন্তানের মনের অবস্থা তখন কী হয়েছিল!
৮ আগস্ট ১৯ রমজান
আমি আমার শাশুড়িকে নিয়ে ফার্মগেট ডা. খাইরুল মুকাদ্দারের চেম্বারে ছিলাম। কোনো একটা বিষয় নিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছিলাম। মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সালাম দিয়ে রিসিভ করলাম। পাঁচ সেকেন্ডের একটি ফোন। মনে হলো আমার পৃথিবীকে ওলটপালট করে দিল। নিজের অজান্তেই চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এল। হঠাৎ এই আমূল পরিবর্তনে আম্মা কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি হুজুরের বিদায় সংবাদ দিলাম। আম্মা এবং ডাক্তার সাহেব ইন্নালিল্লাহ বলে আর্তনাদ করে ওঠলেন। আম্মা বললেন, তুমি এখনই রওনা হয়ে যাও, আমি একটি টেক্সিক্যাব ধরে চলে যেতে পারবো। কালবিলম্ব না করে আমি রাস্তায় নেমে পড়লাম। ফার্মগেট থেকে আজিমপুর, রাস্তা খুব সামান্যই। অথচ আজ রাস্তা যেন শেষই হয় না। বিশেষ কিছু লোককে ফোন করে খবরটি দেওয়া দরকার। সাইলেন্ট করে পকেটে রাখা ফোনটি বের করলাম। সুবহানাল্লাহ! অসংখ্য মিসড্কল স্কিনে ভেসে উঠল। মিসড্কল ব্যাক করা আমার পুরোনো আভ্যাস। কিন্তু আজ আর তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ডায়াল বাটন চাপতেই কোনো না কোনো কল রিসিভ্ড হয়ে যাচ্ছে। পরিচিত অপরিচিত ফোন আর ফোন। সকলের জানার বিষয় হলো হুজুর কি ইন্তেকাল করেছেন? অথচ কী আশ্চর্য! কেউ কথাটি মুখফুটে বলছে না। ‘হুজুরের খবর কী? ‘ভাই একটি খবর শুনলাম।’ ‘খবরটি কি সত্য?’ ‘শাইখুল হাদীস সাহেব হুজুর নাকি... এ জাতীয় শব্দে লোকেরা জানতে চাচ্ছিল। আমিও অতি সংক্ষেপে- হ্যাঁ, জ্বি ভাই, জ্বি ইত্যাদি বলে জওয়াব দিয়ে যাচ্ছিলাম। দুপুর দেড়টায় হুজুরের বাসায় পৌঁছলাম। বাসার সামনের রাস্তা ও-এর আশপাশ লোকে লোকারণ্য। মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনতা বিষণœবদনে প্রতীক্ষমান। কম কথা বলায় অনভ্যস্ত এ সমাজের লোকগুলোকে বড় নীরব মনে হচ্ছিল। ঘণ্টাখানেক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে বাসা সংলগ্ন চাঁদতারা মসজিদে গিয়ে বসলাম। পুরো মসজিদ লোকে পরিপূর্ণ। বেদনাহত হৃদয়ে সকলেই প্রতীক্ষমান শেষবারের মতো প্রিয় উস্তাদ, প্রিয় মুর্শিদের চাঁদবদন প্রত্যক্ষ করার জন্য। আমি খুবই বিস্মিত হলাম শাইখতনয়দের ধৈর্য দেখে। পাহাড়সম বেদনা বুকে চাপা দিয়ে কী অবলীলায় সকলের সঙ্গে কথা বলছেন, লোকদেরকে জানাজার সময় ও অন্যান্য বিষয় জানাচ্ছেন। খবর শোনার পর থেকে অদ্যবধি শাসন অমান্য করে আমার যে চোখ অশ্র“পাত করছিল, তাকে এ থেকে সবক নিতে বললাম। এবার মনে হয় কাজ হলো। অশ্র“পাত বন্ধ হলো।
জানাজার সময় ও দাফন-কাফন 
রমজান মাস, শেষ বিকেলের ক্লান্তি, ইফতার, তারাবি, সাহরি। তদুপরি দাফনের স্থান ঢাকার বাইরে এক নির্জন অঞ্চলে, যেখানে নেই আলো-বাতির কোনো ব্যবস্থা। মানুষজনের সীমাহীন পেরেশানির বিষয়টি সামনে রেখে মশওরায় মতামত এল যে, জানাজা আগামীকাল ছাড়া সম্ভব নয়। এদিকে রমজান মাসের সকাল মানে দশটা সাড়ে দশটা। অগত্যা ফয়সালা হলো আগামীকাল সকাল এগারোটায় জানাজা হবে। মোবাইল, প্রিন্টমিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে মুহূর্তেই এ খবর পৌঁছে গেল দেশের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। 
লাশ দেখার ব্যবস্থাপনা
যুগের ইমাম বুখারি থেকে শেষবারের মতো বিদায় নেওয়ার জন্য উম্মতের শ্রেষ্ঠতবকা নায়েবেনবী ওলামাসমাজ তখন রাজধানী ঢাকার পথে। সারাদিন রোজা রাখার পর পুরান ঢাকা অঞ্চলের লোকদের ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে ঢাকার অন্যপ্রান্ত মোহাম্মাদপুরের দিকে যেতে না হয়, তেমনিভাবে মোহাম্মাদপুর অঞ্চলের লোকদেরকেও অপরপ্রান্তে পৌঁছার সীমাহীন দুর্ভোগ যৎকিঞ্চিত কমানোর নিমিত্তে সিদ্ধান্ত হলো, হযরতের লাশ মুবারক গোসল-কাফন সম্পন্নকরে বাদ আসর বাসা সংলগ্ন চাঁদতারা মসজিদে রাখা হবে। তারাবি শেষ অবধি লাশ এখানেই থাকবে।-এরপর নিয়ে যাওয়া হবে ওই বরকতময় প্রতিষ্ঠানে যে প্রতিষ্ঠানটি শায়খুল হাদীসের সমার্থক রূপ ধারণ করেছিল। সিদ্ধান্ত হলো লাশ পূর্ণরাত জামিয়া রাহমানিয়াতেই থাকবে।-এরপর পূর্বোক্ত কারণের দিকে লক্ষ করে সারাদেশ থেকে রাতব্যাপী আগত লোকদের যাতে মতিঝিল-পল্টন থেকে মোহাম্মাদপুর আসতে না হয় তাই জানাজার জন্য জাতীয় ঈদগাহে নেয়ার পথে হযরতের হাতেগড়া সংগঠন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস কার্যালয়ের  সম্মুখস্ত চত্বরে রাখা হবে হযরতের লাশ। সেখান থেকে সাড়ে নয়টার দিকে জানাজার স্থান জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে নেয়া হবে। এই সিদ্ধান্তের আলোকেই সকলকে তথ্য জানানো হচ্ছিল।
আসমানী অশ্র“র করুণ সুর
ভক্ত-প্রেমিকদের ভিড় গাণিতিক হারে বেড়ে যাচ্ছিল। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয় জানতাম, কিন্তু এতোটা দীর্ঘ হয় জানা ছিল না। আজ জানলাম এবং বড় মূল্য দিয়ে জানলাম। দুঃখ-যাতনায় ভারাক্রান্ত অন্তরগুলো অপেক্ষা করতে করতে একরকম তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলো। অনেকটা ওহুদযুদ্ধের কাক্সিক্ষত বিজয় হাতছাড়া হওয়ার পর সাহাবিদের তন্দ্রার অবস্থা। ৪ টার দিকে মাইকে ঘোষণা হলো হযরতের লাশ এখনই আনা হচ্ছে। সাথে সাথে যেন শোকের অনলে ঘি ঢেলে দেওয়া হলো। নয়ন সিক্ত হলো, ভাষা রুদ্ধ হলো, বদন মলিন হলো। এ শোকের উত্তাপ যেন ছুঁয়ে গেল খোদার আরশকেও। লাশের পালকি মসজিদে ঢোকার মুহূর্তে আকাশ থেকে ঝরঝর বৃষ্টি নেমে এল। আসমানি অশ্র“র করুণ সুর আর ভক্তদের কলিজা পোড়া অব্যক্ত হাহাকার একাকার হয়ে এক অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হলো। আমার বারবার মনে হচ্ছিল কুরআনের ওই আয়াত যেখানে আল্লাহ তায়ালা তার অবাধ্য বান্দাদের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, তাদের জন্য আসমান-জমিন কখনো ক্রন্দন করেনি এবং তারা অসতর্ক ছিলো। আল্লাহর এক প্রিয় বান্দা, সদা সতর্ক বান্দা চলে যাবেন আর আসমান জমিন ক্রন্দন করবে না তাকি সম্ভব! 
 হৃদয়বিদারক দৃশ্য
দেখার সুবিধার্থে কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু সে পরিকল্পনা অনেকটাই ভেঙে পড়ল। কারণ যারা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন, তারাও যেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লেন। সবাই বেসামাল, কে কাকে সামলাবে? সবাই বেবুঝ, কে কাকে বোঝাবে? মাইকে বারবার ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করা হচ্ছিল। কিন্তু ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক মানুষগুলোও আজ ধৈর্যহীন। নিয়ন্ত্রিত মানুষগুলোও বড় নিয়ন্ত্রণহীন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভিড় না কমা পর্যন্ত এগোব না। হঠাৎ মনে হলো নিজের অজান্তেই আমি এগিয়ে যাচ্ছি।
নিজেকে তিরস্কার করে প্রশ্ন করলাম, তুমি কি মাত্র এক সপ্তাহ আগে হুজুরের সাথে দেখা করে যাওনি? তাহলে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যারা হুজুরের সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে কেন অগ্রসর হচ্ছ? শৃংঙ্খলা রক্ষাকারীগণ হিমশিম খাচ্ছিলেন।-এর মধ্যে উপস্থিত হন, শাইখের বিশিষ্ট ছাত্র মুফতি ফজলুল হক আমিনী। শয্যাপাশে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দোয়া-দুরুদ পড়ে প্রিয় উস্তাদ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নিলেন। ভিড় একটু কমে আসলে আসরের জামাত শুরু হলো। নামাজের পর ইমাম সাহেব হুজুরের মদিনাপ্রেমের কথা উল্লেখপূর্বক হুজুরের কবরের সাথে রওজায়ে আতহারের সংযোগ স্থাপনের মিনতি জানিয়ে আবেগঘন দোয়া শুরু করলেন। কান্নার রোল পড়ে গেল মসজিদ জুড়ে। সকলেই কাঁদছে অবুঝ শিশুর মতো। মসজিদের ইট-পাথর আর দেয়ালও যেন শরীক হলো সে কান্নায়। ইথারে ভেসে ভেসে সে কান্না পৌঁছে গেল খোদার আরশে। কেঁদে উঠল আসমান জমিন। ঝরঝর শব্দে আবার আসমান অশ্র“ বিসর্জন করলো। নামাযের পর ভিড় একটু কম থাকায় একটি ফ্রিজিং গাড়িতে করে লাশ মসজিদের সামনে রাখা হলো। হালকা বৃষ্টি উপেক্ষা করেই উম্মত নায়েবে নবীকে শেষ দেখা দেখছিলেন। লাইন অনেক দীর্ঘ না হলেও দেখা অব্যাহত ছিল। সর্বসাধারণ থেকে শুরু করে ঢাকা ও-এর আশপাশের মাদরাসা, মসজিদ, খানকাহ থেকে অগত মুহতামিম, মুফতি, মুহাদ্দিস, ইমাম, খতিব ও পীর সাহেবগণ দলে দলে চূড়ান্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে হযরতের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছিলেন।
জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে
ঈদের জামাত উপলক্ষ্যে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে শামিয়ানা টাঙানোর প্রস্তুতি চলছিল। বাঁশ-খুঁটি ইত্যাদি এলোমেলো রাখার কারণে ময়দান জানাজার উপযুক্ত আছে কি না, পাশাপাশি কোন পজিশনে এবং কীভাবে লাশ দেখালে সুন্দর সুশৃংঙ্খলভাবে দেখানো সম্ভব হবে, এই সার্বিক বিষয় তদারকির জন্য শাইখের একান্ত স্নেহভাজন মাও. আতাউল্লাহ আমীনসহ জামিয়া রাহমানিয়ার নবীন ফারেগিন হযরতের জন্য পাগলপ্রাণ একঝাক তরুণ আলেম নিয়ে বাদ মাগরিব জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে এলাম। সরেজমিনে এসে সার্বিক ব্যবস্থাপনার একটি নিখুঁত ছক আঁকা হলো। বাঁশ-রশি সংগ্রহসহ কিছু কাজও করা হলো। কিন্তু প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাবে কাজ অসম্পূর্ণ রেখে ফিরে এলাম। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কাজটি তত্ত্বাবধান করছিল। সিদ্ধান্ত হলো, সাতসকালে কর্পোরেশনের লোকদের সাথে শরিক হয়ে বাকি কাজ সম্পন্ন করা হবে।
হাইকোর্ট মসজিদে এশা-তারাবি শেষ করে রাহমানিয়ার পথে রওনা হলাম। গাড়িতে থাকাবস্থায় ভ্রাতৃপ্রতীম মাও. ইউনুস আনওয়ার ফোন দিলেন দ্রুত মাদরাসায় পৌঁছার জন্য। মাদরাসার সামনে গিয়ে দেখলাম এক এলাহী কাণ্ড। মানুষ আর মানুষ। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ঢাকা ও-এর আশপাশের শত শত মাদরাসার অগণিত হাফেজ, আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস। আছেন ফেরেশতাদের বিশেষ সম্মানপ্রাপ্ত তালেবে এলেমদের জামাত। মূলত ইউনুস আনওয়ার ভাই এদের সামলাতে মাইক্রোফোনের সামনে হিমশিম খাচ্ছিলেন। রাত তখন দশটার ওপরে। মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারাবির পর পরই লাশ রাহমানিয়ায় চলে আসার কথা। কিন্তু শাইখের এক মেয়ে যাত্রাবাড়ির জ্যামে আটকা পড়ায় হযরতকে আনতে বিলম্ব হচ্ছিল। অপেক্ষমান মানুষের চাপ প্রতিমুহূর্তে বেড়ে যাচ্ছিল। সারাদিন রোজা রেখে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে তারাবি পড়ার পর এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কী যে কষ্টকর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শাইখের প্রতি তাদের এই সীমাহীন ভালোবাসার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে অনুরোধ জানাচ্ছিলাম। তবে আমার এই অনুরোধ সম্পূর্ণ বেমানান ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছিল। কারণ প্রতিটি মানুষ ধৈর্যের অবতার সেজে অপেক্ষা করছিলেন। না ছিল কোনো শোরগোল, না ছিল কোনো অভাব-অভিযোগ। যখন বুঝলাম যে, সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা ছাড়া শাইখের এই আশেকদেরকে অন্যথায় নেওয়া সম্ভব নয়, তখন বাধ্য হয়ে ঘোষণা করলাম-হযরতের লাশ আসতে বেশ খানিকটা দেরি হবে আপনারা মেহেরবানি করে মাদরাসার ৪র্থ তলায় অথবা সাতমসজিদ চত্বরে গিয়ে বসুন। এবার বাইরের ভিড় খানিকটা কমে এলো। রাত যখন ১২ টা পেরিয়ে গেল, তখন লাশ রাহমানিয়ায় নিয়ে আসা হলো। সাড়ে বারোটার দিকে হুজুর রাহমানিয়ার সন্নিকটে পৌঁছলেন। যে জামিয়ায় হুজুর হাজার বার এসেছেন, হাজার হাজার বার এসেছেন। কখনো পায়ে হেটে, কখনো গাড়িতে চড়ে, আবার কখনো বা হুইল চেয়ারে ভর করে। চিরচেনা চত্বর, চিরচেনা অলিগলি। আপনজনে পরিপূর্ণ প্রাঙ্গন। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির স্বপ্নদ্রষ্টা-প্রাণপুরুষ আসবেন এতো অতি সাধারণ বিষয়। কিন্তু তা নিয়ে আজ এত মাতামাতি আর কৌতুহল কেন?
এই কেন-র জবাব বড় কঠিন, এই কেন-র জবাব বড় নিষ্ঠুর। তাই তো হযরত শাইখ তার হৃদয়তুল্য জামিয়ায় শেষ বারের মতো আসছেন, এই ছোট্ট কথাটি বলতে জগতের সকল ভাষা হারিয়ে ফেললাম। অপেক্ষমান অগণিত ভক্তকুলের চোখ ফেটে অশ্র“র বন্যা নেমে এল। হুজুর আর কখনো আসবেন না তার জামিয়ায় এ ব্যথা যেন আকাশ বাতাস সবার জন্য অসহনীয় হয়ে উঠল। তাই তো আকাশ তার নিজস্ব ভাষায় আবার কেঁদে ওঠলো। আকাশের ক্রন্দনে ভিজে একাকার হলো ভক্তকুল। মাদরাসা সংশ্লিষ্ট সংকীর্ণ চত্বর, প্রতিকূল আবওহাওয়া, প্রচণ্ড ভিড় সবকিছু মিলে এক কঠিন পরিস্থিতি। বৃষ্টির কারণে পূর্বের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে নতুন পরিকল্পনা করা হলো। হযরতকে দুই গেটের মাঝামাঝি মাদরাসার চত্বরে রাখা হলো। দর্শনার্থীগণ বাইরের মূল ফটকের পশ্চিমদিকের ছোট  গেট দিয়ে প্রবেশ করে জামিয়ার দক্ষিণ দিকের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে।-এরপর নিচতলার করিডোর দিয়ে উত্তরদিক তথা মাঝখানের গেটের কাছে চলে যাবে এবং এই গেটদিয়ে বের হয়ে হযরতকে দেখে মূল ফটকের পূর্বদিকের ছোট গেট দিয়ে বের হয়ে যাবেন। আর আমরা পুরো ব্যাপারটি পর্যোবেক্ষণের নিমিত্তে দক্ষিণ দিকের গেটের ওপর দোতলায় রাহমানী পয়গাম অফিসের সামনের বারান্দায় দাঁড়ালাম। এ স্থানটায় দাঁড়াতেই অসংখ্য স্মৃতি আমার হৃদয়পটে ভেসে উঠল। রাহমানিয়ায় শিক্ষকতার এক দশকে রাহমানী পয়গামের সম্পাদনা বিভাগেও কাজ করেছি। ক্লাস শেষে বিকেলবেলা যখন পত্রিকার কাজে ডুবে যেতাম তখন এই বারান্দা একদল বাচ্চাদের কলকাকলী ও আনন্দধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠতো। কিন্তু বাচ্চাদেরকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার পরিবর্তে মাঝে মাঝে আমিও এসে এই আড্ডায় যোগ দিতাম। কারণ এই অনুষ্ঠানের মধ্যমণি থাকতেন হযরত শাইখুল হাদীস রহ.। হুজুর হুইল চেয়ারে এখানে বসার সাথে সাথে হিফজ ও মক্তব বিভাগের একঝাঁক ফুলকলি হুজুরকে ঘিরে ধরত। শুরু হতো নানা আর নাতিদের গল্পের আসর। চলত আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত। যখন আসর খুব জমে উঠত, তখন আমিও হতাম সে আসরের মুগ্ধশ্রোতা। চেয়ে চেয়ে দেখতাম, শিশুর সরলতা নিয়ে কী সুন্দর শিশুদের দলে মিশে গেছেন একজন বৃদ্ধ শিশুও। বারবার মনে পড়ত কুরআনের ওই শাশ্বত আয়াত ‘আমি যাকে দীর্ঘজীবন দান করি তাকে সৃষ্টিগত পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিই, তারপরও কি তোমরা বোঝ না’। আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে দেখতাম, কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনে, বাবরি মসজিদ লংমার্চে, তাসলিমা-আহমদ শরীফ বিরোধী আন্দোলনে, খেলাফত প্রতিষ্ঠার উত্তপ্ত রাজপথে যিনি সিংহের ন্যায় গর্জে উঠতেন, তিনি আজ কী ছোট্ট শিশুতেই না পরিণত হয়েছেন। এসব স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে আমি দ্রুত বাস্তবে ফিরে এলাম। কারণ উম্মতের বাঁধভাঙা জোয়ার সামাল দিতে হবে। আমি মাইক হাতে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছিলাম। জামিয়ার সকল ছাত্র-উস্তাদগণ জানতোড় মেহনত করে যাচ্ছিলেন।
আলহামদুলিল্লাহ! অত্যন্ত শৃংখলার সাথে চলছিল শেষদেখা ও শেষবিদায়ের পর্ব। অপেক্ষমানদের দেখা শেষ হতে রাত তিনটা পার হয়ে গেল। জামিয়ার অধিকাংশ ছাত্র-উস্তাদ নির্ঘুম রাত কাটালেন। শেষ রাতে মেহমানদের জন্য সাহরির ব্যবস্থা করা হলো। ফজরের পর থেকে ঢাকার অসমাপ্ত লোকজন এবং সারাদেশ থেকে নাইটে আগমনকারীদের ভিড় আবার বাড়তে আরম্ভ করলো। বাদ ফজর থেকে আবার রাত্রের নিয়মেই লাশ দেখানো শুরু করলাম। লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছিল। দিনটি ছিল ২০ রমজান। মাগফিরাত আর জাহান্নাম থেকে মুক্তির মোহনায় দাঁড়িয়ে মুমিনগণ। তোড়জোড় ছিল দিনশেষে এ’তেকাফে বসারও। সব ব্যস্ততার মধ্যেই উম্মত পঙ্গোপালের ন্যায় ছুটে আসছিল হযরতকে দেখার জন্য। জামিয়া রাহমানিয়ার সামনে লম্বা লাইনে অপেক্ষমান ঢাকাসহ সারাদেশর মাদরাসা থেকে আগত শীর্ষস্থানীয় আলেমেদীনÑ মুহতামিম, মুফতি, মহাদ্দিসগণ। যাদের ব্যস্ততা পাহাড়সম। কিন্তু শাইখের সম্মানেÑ শাইখের ভালোবাসায় সব ব্যস্ততা আজ তুচ্ছ-নগন্য।
অসংখ্য অগণিত মানুষের ভিড়ে আমার চোখ দুটি মনের অজান্তেই শাইখের কিছু একান্ত ছাত্রকে খুঁজে ফিরছিল। দিবস শেষে রজনী এলো, রজনী গভীর হলো, রজনী শেষও হলো। কিন্তু আমার চোখের তৃষ্ণা  থেকেই গেল। ফজরের পরও বিষয়টিকে মাথা থেকে তাড়াতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। অদৃশ্য এক বেদনা আমাকে পেয়ে বসেছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম জামিয়া রাহমানিয়া আলী অ্যান্ড নূরের একজন শিক্ষক লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সাথে সাথে মাইকে ঘোষণা দিলাম, হুজুরকে লাইন থেকে এনে বিশেষ ব্যবস্থায় দেখানোর জন্য। কিছু সময় পরই লক্ষ্য করলাম উক্ত জামিয়ার উস্তাদগণ একে একে এগিয়ে আসছেন। আমি সকল উস্তাদগণকে বিশেষভাবে দেখানোর জন্য ঘোষণা দিলাম এবং সেভাবেই দেখানো হলো। কিন্তু আমার দৃষ্টি তখনো পুরোপুরি তৃপ্ত নয়।
আবেগ আর ভালোবাসায় পরাজিত অভিমান 
অবশেষে সকল অভিমান পরাজিত হলো শ্রোদ্ধা আর ভালোবাসার কাছে। শাইখের একান্ত স্নেহের ছাত্র, দীর্ঘদিনের সহচর মাওলানা হিফজুর রহমান মুমিনপুরী হুজুর। প্রিয় উস্তাদের প্রতি ভীষণ রাগ আর অভিমান নিয়ে শাইখকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। সেই উস্তাদ আজ সকল মান-অভিমানের উর্ধে। প্রিয় উস্তাদের লাশ তার ঘরের কাছে এনে রাখা হয়েছে আট-দশ ঘণ্টা হয়ে গেল। কিন্তু শেষ সাক্ষাতের জন্য আসেননি তিনি। লাশ আর সামান্য সময়ই এখানে থাকবে। তাই অনেকেই অপেক্ষমান ছিল শেষ পর্যন্ত কী ঘটো? কিন্তু বেদনার বহ্ণিশিখায় ছাই হয়ে গেল অভিমানের সকল ইন্ধন। থাকনা শত অভিযোগ-অনুযোগ, থাকনা হাজারো মতপার্থক্য। এমন প্রিয় উস্তাদ চিরজনমের জন্য চলে যাচ্ছেন আর তাকে শেষবারের মতো দেখতেও যাব না তা কি সম্ভব? মুমিনপুরি হুজুর আসলেন আমরা আবেগআপ্লুত হয়ে পড়লাম। সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে ভলেন্টিয়ার ভাইয়েরা প্রিয় ছাত্রকে উস্তাদের কাছে নিয়ে গেল।-এর পরের দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া থেকে বঞ্চিত হলাম। দোতলায় থাকার কারণে শামিয়ানার আড়ালে পড়ে গেল সব। 
আসহনীয় এক কাক্সিক্ষত দৃশ্য
এর একটু পরেই উপস্থিত মজলিসে হঠাৎ চাঞ্চল্যা সৃষ্টি হলো। লাইন ভেঙে লোকজন ছুটাছুটি শুরু করল। দেখলাম, ধরাধরি করে লোকজন কাউকে নিয়ে আসছে। দুর্বলতার কারণে আসতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তিনি শরীরের সকল শক্তি ব্যয় করে লাশের দিকে ধেয়ে আসছিলেন। চেহারাটি দেখার পর আমারও ইচ্ছে হলো দৌড়ে ওই ভিড়ে মিশে যেতে। তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয়তম ওস্তাদ, হযরত শাইখের প্রিয়তম ছাত্র, একজন আদর্শ ছাত্র ও আদর্শ ওস্তাদের উজ্জ্বল নমুনা শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল হাই পাহাড়পুরি দা. বা.। হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানীর উস্তাদপ্রেমের অতুলনীয় দৃষ্টান্তের কথা আমরা শুনেছি- উস্তাদের বিরহ সইতে না পেরে স্বেচ্ছা কারাবরণের জন্য তিনি সাগরে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। শাইখের খিদমতে পাহাড়পুরী হুজুরের অনেক ঘটনা আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে হযরত মাদানীর ইতিহাস। আমি আমার ক্ষুদ্রজীবনে উস্তাদের প্রতি উৎসর্গপ্রাণ এমন ছাত্র আর দেখিনি। নিজে দেশের শ্রেষ্ঠতম শাইখুল হাদীস। অথচ উস্তাদ শায়খুল হাদীসের সামনে এমন বিনয়ের অবতার হয়ে বসতেন যে, কোনো শব্দই তা ব্যক্ত করতে যথেষ্ট নয়। এইতো সেদিনের কথা। হুজুর দাওরায়ে হাদিসের সবক শেষ করে শাইখের রুমে ঢুকলেন। আমরাও ঢুকলাম হুজুরের পিছে পিছে। রুমে ঢুকেই হুজুরের সামনে তাশাহহুদের সুরতে নতজানু বসে হাত-পা দাবাতে আরম্ভ করলেন। খাদেমের হাত থেকে তেল নিয়ে মাথায় তেল দিতে আরম্ভ করলেন। হুজুর যতই বারণ করছেন, তিনি তার কাজ চালিয়েই যাচ্ছেন আর বলছেন, হুজুর আমি আপনার খাদেমÑ আমি আপনার গোলাম। মনে চায় আপনার খেদমতে পড়ে থাকি, কিন্তু মানুষজন কেন যে এতো পীড়াপীড়ি করতে থাকে; কিতাব পড়াওÑ কিতাব পড়াও। শাইখ হেসে বললেন, ‘আমার খেদমতের বহু মানুষ আছে। কিতাব পড়ানোর লোকের বড় অভাব। তুমি অবশ্যই কিতাব পড়াবে। আমি তোমার জন্য দোয়া করি। তোমার পড়ানো আমার খুব ভালো লাগে।’ এই কথা শোনার পর পাহাড়পুরি হুজুর শাইখের হাত ধরে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। 
আহ! কোথায় পাব এমন ছাত্র, আর এমন ওস্তাদ। হুজুর লাশের পাশে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন।-এরপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে শাইখের চোখে মুখে এমনভাবে চুমু খেতে আরম্ভ করলেন যে, উপস্থিত কেউ আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। আল্লাহর এই প্রিয়বান্দা আজ অকাল বার্ধক্যের শিকার। রোগ-শোক আর শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি প্রায় শয্যাশায়ী। ওগো মাবুদ! তুমি হুজুরকে পূর্ণ সুস্থতা দান করে তার ছায়াকে এই উম্মতের ওপর দীর্ঘ করে দাও।
সকাল সাড়ে সাতটার দিকে পল্টন ও জাতীয় ঈদগাহের সর্বশেষ অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য রওনা হয়ে গেলাম। নিবেদিতপ্রাণ ট্রাক ভর্তি ছাত্র নিয়ে প্রথম গেলাম পল্টনে। সেখান থেকে আসলাম জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। রাত্রের আঁকা ছক অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে আতাউল্লাহ আমীন ভাই ভলান্টিয়ারদের জন্য ব্যাজ বানিয়ে দিলেন। ব্যাজ লাগিয়ে প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালাম।
জাতীয় ঈদগাহ ময়দান
আমরা ময়দানে পৌঁছলাম আটটার দিকে। জানাজার এখনো তিন ঘণ্টার ওপরে বাকি। অথচ জাতীয় ঈদগাহের বিশাল ময়দানে ৮ থেকে ১০ কাতার মুসল্লি তখনি উপস্থিত। সূর্যের কঠোর শাসন ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এই রোদ উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কমপক্ষে এগারোটা পর্যন্ত। শৃংখলা বিধানে সামনের লাইন থেকে কিছু লোককে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ছাত্ররা চেষ্টা করছিল। তাদেরকে অনমনীয় দেখে আমি এগিয়ে গেলাম। আমি একটু কঠোর হওয়ার চেষ্টা করলে একজন লোক চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো, ভাই হুজুরকে দেখার জন্য- সামনের কাতারে নামাজ পড়ার জন্য ফজরের অনেক পূর্বে এখানে এসে জায়গা নিয়েছি। আমাদেরকে ধমকাচ্ছেন কেন, আমরা কি কোনো অপরাধ করেছি? অপরাধ থাকলে সেটা হলো, আমরা হুজুরকে ভালোবাসি। আপনারা সবসময় হুজুরের কাছে থাকেন তাই আপনারা আমাদের ব্যথা বুঝবেন না।
সত্যি কথা বলতে কি, আমার চোখেও পানি চলে এলো। আমি ছাত্রদের বললাম তাদেরকে এখানে রেখেই কোনো ব্যবস্থা করো। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে মিম্বার থেকে সামান্য দূরত্বে বাঁশ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা করিডোর বা লাইন করা হলো। লাইনের শেষ প্রান্তে লাশ রাখা হলো। সিদ্ধান্ত হলো, লোকেরা উত্তর দিক দিয়ে প্রবেশ করে দক্ষিণপ্রান্তে পৌঁছে দেখা শেষ করে মাঠের পাশ দিয়ে পেছনে গিয়ে নামাজের জন্য কাতারে দাঁড়াবে। আমি মূলত: হযরতের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পাশাপাশি মাঠের শৃংখলা রক্ষায় সকলকে আন্তরিক হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করছিলাম। লোকদের উপর্যুপরি চাপ সত্ত্বেও পূর্ণ শান্তি-শৃংখলার সাথেই সময় গড়াচ্ছিল। ১০ টার মধ্যেই জাতীয় ঈদগাহ পূর্ণ হয়ে গেল। পাগলপ্রাণ বনি আদমের ক্রমবর্ধমান চাপে যে কোনো সময় শৃংখলা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছিলাম। দশটার সময় মামুন ভাই মাইক্রোফোনের সামনে এসে আমাকে বিশ্রাম দিলেন। গত রাতে দশটা থেকে চারটা, সকালে দুই ঘণ্টা এবং এই মাঠে আরও দুই ঘণ্টার ওপরেÑ এই দীর্ঘ নয়-দশঘণ্টা কথা বলতে বলতে আমি ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম।
মামুন ভাই শুরুতে হুজুরের বর্ণাঢ্য জীবনের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করে হুজুরের জীবনের শেষ দিনগুলির ওপর একটি সারগর্ভ বক্তব্য দিলেন।-এরপর উপস্থিত শীর্ষ আলেমেদীন, মন্ত্রী-এমপি ও দেশের বিশিষ্টজনদের অভিমত শোনার জন্য তাদেরকে মাইক্রোফোনের সামনে আহ্বান করলেন। সময় স্বল্পতার দরুণ অনেককেই সময় দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করলেন। একটানা বক্তৃতা চলার কারণে মাঠের শৃংখলা ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। ইতোমধ্যে মাঠে প্রবেশ করলেন শাইখুল হাদীসের বিশিষ্ট ছাত্র মুফতি ফজলুল হক আমিনী। সরকারি বাধ্যবাধকতা থাকায় তিনি বক্তৃতা দিতে আস্বীকৃতি জানালেন। সরকারের মন্ত্রী-এমপি উপস্থিত থাকায় উপস্থিত জনতা সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে স্লোগান দিতে আরম্ভ করলো। অবশেষে আমিনী সাহেব সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলো। জানাজার সময় ঘনিয়ে আসায় লোকজন লাশ দেখার জন্য ধাক্কাধাক্কি শুরু করলো। এমন সময় মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলো, লাশ আর দেখানো হবে না। আপনারা নামাজের জন্য কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে যান। এই ঘোষণার সাথে সাথে মাঠের শৃংখলা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। শাইখের হাজার হাজার ভক্তকুল যারা রাত জেগে জেগেÑ শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, তারা জোশের বশবর্তী হয়ে হুঁশ হারিয়ে ফেললেন। কোনো ঘোষণা আর অনুরোধ-উপরোধই কাজে আসলো না। সব পরিকল্পনা বালির বাঁধের ন্যায় ভেঙে গেল, কাগজের ঘরের ন্যায় তছনছ হয়ে গেল।
জানাজার নামাজ
স্মরণকালের সর্ববৃহৎ গণজমায়েত আজ জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। যাদের সিংহভাগই উম্মতের শ্রেষ্ঠতবকা আলেম, হাফেজ, মুফতি, মুহাদ্দিস বা শাইখুল হাদীস। এই মজলিসের সর্বনিম্ন হচ্ছে এ সমাজের দীনদার হাজিগাজি শ্রেণী। এগারটার পর আরও দশ-পনেরো মিনিট পার হলে, ইমামতির জন্য আগে বাড়লেনÑ শাইখতনয় মাওলানা মাহফুজুল হক। এমন ভিড় সৃষ্টি হলো যে, মিম্বারের আশপাশের ভিআইপিরাও ভিড়ে চেপটা হওয়ার উপক্রম। ঈদের নামাজের সামিয়ানা টানানোর জন্য খুঁটি পোতা হয়েছিল। দুই সারি খুঁটির মাঝে দুই কাতার লোক দাঁড়ানোর ব্যবস্থা ছিল। সেখানে দুই খুটির মাঝে লোক দাঁড়ালো দশ কাতার। দশ কাতার কথাটাও সঠিক হলো না। বরং গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে যতো দাঁড়ানো সম্ভব ততোই দাঁড়ালো। সে এক অকল্পনীয় দৃশ্য। ‘তিল ধারণের ঠাঁই নেই’ বলে একটা কথা জানতাম, কথাটা সেদিন উপলব্ধিও করলাম।
জানাজায় ঢাকা শহরের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল ওলামায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন। অনেক ওলামা হযরত ওমরায় থাকার কারণে শরিক হতে পরেননি। এদের অনেককেই না থাকতে পারার বেদনা প্রকাশ করতে দেখেছি। এমনি একজন বেদনাহত দুঃখী  মানুষের নাম মাওলানা মুফতি আশরাফুজ্জামান। যিনি শাইখুল হাদীস আর তার জামিয়ার জন্য বলতে গেলে জীবন-যৌবন সবই ওয়াক্ফ করেছেন। শত দুঃখ-যাতনা, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা হাসিমুখে সয়েছেন শায়খুল হাদীসের মুহাব্বতে। শাইখুল হাদীস যখন আমাদের এতিম করে চলে যাচ্ছেন; শাইখপাগল এই মানুষটি তখন মক্কায় বন্দী। দরুসুল বালাগায় একটি শে’র পড়েছি, পড়িয়েছিÑ ‘আমার প্রিয়তম ইয়ামেনি কাফেলার সঙ্গে চলে যাচ্ছে, আর আমার দেহ মক্কায় বন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। ১৯ রমজান হুজুর মক্কায় বন্ধি।-এরপর যদিও মুক্ত হয়ে উড়াল দিলেন, কিন্তু মিলন আর ঘটল না। পাকিস্তান ট্রানজিট থাকায় শত চেষ্টার পরও তিনি যখন পৌঁছলেন, তখন শাইখ হুজুর থেকে মাত্র তিন হাত দূরে। কিন্তু এই তিন হাতই হাজার হাজার মাইল দূরত্বের সমান। এ যেন বহু ক্রোশ পাড়ি দিয়ে মাত্র দুই আঙুলের জন্য পানি তুলতে অক্ষম এক পিপাসিত পথিক। এমন আরও অনেকেই সেদিন পিপাসাকাতর অবস্থায় অশ্র“ ঝরিয়েছে। 
নতুন বাড়ির পথে শাইখুল হাদীস
জানাজা শেষে লাশ কাঁধে নেওয়ার সে যে কি প্রচেষ্টা, তা বোঝানোর কোনো ভাষাই আমার জানা নেই। আমি ভুলে লাশের দিকে একটু এগিয়েছিলাম। পরক্ষণেই জীবন বাঁচাতে সেখান থেকে সরে আসলাম। প্রিয় পাঠক! মাফ করবেন। ‘ভুলে’ শব্দটি দেখে আমাকে ভুল বুঝবেন না। সেদিন জানাজার সামনে যারা ছিলেন না, তাদের  এই ব্যাপারটি পুরোপুরি বুঝে আসবে না। প্রচণ্ড ভিড়ে পদপৃষ্ট হয়ে লোক মারা যাওয়ার অথবা অহত হওয়ায় খবরাখবর আমরা অনেক সময় পত্র-পত্রিকায় দেখি। সেদিন এমন একটা পরিস্থিতি খুব কাছে থেকে দেখলাম। আল্লাহর শুকুর যে বড় ধরণের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। ওই ভিড়ের মধ্যে হুজুরের দুজন ছোট ছোট দৌহিত্রও পড়ে যায়। মামুন ভাই আর আমি বহুত কষ্টে তাদেরকে নিরাপদে নিতে সক্ষম হই। মামুনভাই তো রাগ সামলাতে না পেরে তাদেরকে প্রহার করতে আরম্ভ করেন। যাহোক জাতীয় ঈদগাহের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের গেট দিয়ে লাশ গাড়িতে ওঠানো হলো। 
আমি ওই বাচ্চা সংশ্লিষ্ট বিলম্বের কারণে জানাজার সঙ্গে যাওয়ার জন্য নির্ধারিত কোনো ট্রাকে আর উঠতে পারলাম না। পরিচিত একজনের প্রাইভেটকারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, যদি সুযোগ মিলে যায়। কিন্তু সেখানেও সুযোগ হলো না। অগত্যা ছোটাছুটি শুরু করলাম। এদিক থেকে সেদিক, সেদিক থেকে এদিক। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা-ই হচ্ছে না। সি.এন.জি, অটোরিকশা কিছুই পাচ্ছি না। হতাশা আর হতাশা। ঢালকানগর মাদরাসার মুহাদ্দিস, বন্ধুবর মাও. মুফতি শফিক ভাইও আমার মতো খোঁজাখুঁজির মধ্যে ছিলেন। তাকে বললাম, কোনো ব্যবস্থা হলে আমাকে অবশ্যই নিয়ে যাবেন। মানুষের ভিড়ে আশপাশের কোনো রাস্তা-ই দ্রুত হেঁটে যাওয়ার উপযুক্ত নয়। গাড়ির তো প্রশ্নই আসে না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ভার্সিটির মধ্য দিয়ে হেঁটে নিউমার্কেট বা বেড়িবাঁধ চলে যাব। তারপর এক ব্যবস্থা হবেই। হাঁটা শুরু করার পূর্বমুহূর্তে শেষবারের মতো এদিক-ওদিক তাকালাম। শাইখ যে গাড়িতে চলাচল করতেন, তেমন একটি গাড়ি এসে হাইকোর্ট মাজার প্রধান গেটে এসে থামল। ড্রাইভার দেখে নিশ্চিত হলাম এটা শাইখের গাড়ি। ভেতরে খালি দেখে এগিয়ে গেলাম। ড্রাইভার থেকে জানলাম, শাইখের কয়েকজন নাতিকে খুঁজছেন। আমি তাদেরকে ফোন দিয়ে জানলাম তারা বিভিন্নভাবে রওনা হয়ে গেছে। ড্রাইভার এবার দরজা খুলে দিল। ভেতরে বসে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম। এই গাড়িতে চড়ে শায়খুল হাদীসের সঙ্গে বহু সফরে গিয়েছি। আজও সেই গাড়িতে যাচ্ছি, কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে নেই। শফিক ভাইকে খুঁজতে খুঁজতে রাহমানিয়ার মুহাদ্দিস মুফতি শফিকুল ইসলাম সাহেবকে পেলাম। তাকেসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে রওনা হলাম। আজিমপুর-হাজারীবাগ হয়ে বেড়িবাঁধ পৌঁছলাম। বেড়িবাঁধ মোহাম্মাদপুর হয়ে আটিবাজারের রাস্তায় উঠতেই দেখলাম, লাশবাহি গাড়ি আমাদের পেছনে। গাড়ি স্লো করে লাশের সঙ্গে আটিবাজারের পথে রওনা হলাম।
আটিবাজার এমারগাঁওয়ে শাইখুল হাদীস 
মোহাম্মাদপুর এসে লাশের বহর দেখে মনে হলো, কোনো রাষ্ট্রীয় মেহমানকে রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হোন্ডা, প্রাইভেট, মাইক্রো ও ট্রাকের এক বিশাল বহর হুজুরের সঙ্গে। বাস্তবেই  তো তিনি আজ রাজকীয় মেহমান। তবে দুনিয়ার কোনো রাজা-বাদশার নয়, স্বয়ং রাজাধিরাজ মহান আল্লাহর মেহমান। শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু  উদ্বোধনের পর এ অঞ্চল যথেষ্ট জমজমাট। কিন্তু তার পরও এতো বড় বহর নিয়ে লাশ দাফনের ঘটনা বিরল। বড় রাস্তা পার হয়ে লাশ যখন আটিবাজার ব্রিজের আগের ছোট রাস্তায় প্রবেশ করলো তখন প্রচণ্ড জ্যাম সৃষ্টি হলো। আমরা গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। আটিবাজার প্রবেশের পূর্বের মোড় থেকে বহর যখন ডানদিকের গ্রামে প্রবেশ করলো। তখন এলাকা জুড়ে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। তারা যখন জানলো যে, শাইখকে এখানে দাফন করা হবে তখন বেদনার মাঝেও তাদের ঈদ শুরু হলো। লোকেরা বাড়ি-ঘর থেকে বের হয়ে দলে দলে লাশের বহরে শরিক হলো। আমার বাসা আটিবাজার এলাকায় হওয়ায় কবরস্থান সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করেছিলাম। কিন্তু আমার ধারণা পার হয়ে বহর যখন আরো মাঠের দিকে এগিয়ে গেল, তখন মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। পা যেন আর চলছে না। হায় হুজুরকে এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? পীচঢালা পাঁকা রাস্তা শেষ হয়ে ইটের রাস্তা শুরু হলো। ভাবলাম কবর হয়তো ইটের রাস্তার সাথে। কিন্তু না ইটের রাস্তাও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু কাফেলা চলছে তো চলছেই। এবার বুক ফেটে হুহু করে কান্না আসলো, হায়! হুজুরকে বনবাসে দিতে কোন তেপান্তরে নিয়ে যাচ্ছি? শুরু হলো কাঁচামাটির সরু রাস্তা। বাড়ি ঘরের চিপাচাপি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এক বিরাট কাফেলা। আর কতোদূর? কাঁচা রাস্তাও শেষ হয়ে গেল। শুরু হলো বুক সমান নল-খাগড়ায় ঢাকা মেঠো পথ। অভমানী মন আমাকে প্রশ্ন করলো, মেঠো পথ পার হয়ে আরো সামনে যাবে নাকি? এ প্রশ্নে আমি লজ্জা না পেয়ে ব্যথা পেলাম। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অনুভূতি আর কোনো কাজ করছে না। যান্ত্রিক রোবটের মতো এগিয়ে যাচ্ছি, শুধুই এগিয়ে যাচ্ছি। এক সময় নিজেকে আবিস্কার করলাম একটি কবরের সামনে। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে প্রখর রোদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ দুটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ কসময় জামিয়ার ফুজালা বন্ধুবর মাওলানা ফরহাদ ভাই আলতো করে আমার হাতটি ধরে বললেন, আসুন! হুজুরের কবরে মাটি দিবেন না? সবাই মাটি দিচ্ছে। নীরবে তাকে অনুসরণ করলাম। মন আমাকে বললো, মাটি দিবে না মানে! তুমি অবশ্যই মাটি দিবে। মাটি দিতেই তো হুজুরকে এই মাঠে নিয়ে এসেছো। চতুর্দিকে মাটি আর মাটিÑ যতো খুশি মাটি দাও। সবার সঙ্গে মাটি দিলাম। জনমের তরে মাটি দিলাম। এই অপদার্থ ছাত্ররা হুজুরকে কী-ইবা দিতে পেরেছি। তাই মাটি দিয়েই যেন এলমের সব ঋণ শোধ করে দিচ্ছি। এই না হলে ছাত্র! কেউতো পারলে হুজুরের কলিজাটাই জ্বালিয়ে ভস্ম করার জন্য জীবন বাজি রাখছি। ধরণি দ্বিধা হও। 
ভিড় একটু কমলে কবরের দেয়াল ধরে  কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকতাম হুইল চেয়ার ধরে। সারাদিন রোজা রেখে দৌড়ঝাপের পর শরীর যেন আর চলছে না। যোহরের নামাজের বিষয় না থাকলে হয়তো ওখানেই পড়ে থাকতাম। এমারগাঁও বড় মসজিদে এসে যোহর পড়লাম। নামাজ শেষে হুজুরের জন্য দুআ মাহফিল, কবরে হালকা পাহারাদারি, জিয়ারতকারীদের জন্য কবরস্থান  চেনার জন্য কী করণীয় এজাতীয় আরও কিছু বিষয় নিয়ে মাহফুজ সাহেব হুজুর আমাদের সঙ্গে কথা বললেন। হুজুরের বিদায় এবং কবরস্থানের পরিবেশের কথা যখনই মনে আসছিলো মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থা নিয়ে আসরের একটু আগে আটিবাজার মাদরাসায় ফিরে এলাম। অজু-গোসল সেরে নামাজ পড়লাম। নামাজের পর মনেহয় একটু ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে ওঠার পর নিজের মধ্যে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।
মন প্রশান্ত হলো অনেক কেন-র জওয়াবও পেলাম
কেন এই বিজন মরুভূমিতে হুজুরকে বনবাস দেওয়া হলো? কেন সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন মদিনায় কবর হলো না? কেন আজিমপুর বা গমনাগমন সহজ কোনো স্থানে হুজুরের কবর হলো না? এমন নানা প্রশ্ন আমার ভেতরে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল। কোনো সান্ত্বনাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঘুম থেকে ওঠার পর মনটা শান্ত হয়ে এলো। মন আমাকে বললো, তুমি কি জান না নবীজি সা.-এর কবর মদিনায় কেন হলো? এটা কি এজন্য নয় যে, নবীজির সবচেয়ে বিপদের দিনে মদিনাবাসি নবীজির পাশে দাঁড়িয়েছিল? হযরত শাইখুল হাদীসকে যখন তার প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মমভাবে বের করে দেওয়া হয়, তখন কি এই আটিবাজারবাসি হুজুরকে বুকে টেনে নেয়নি? মদিনাবাসির কুরবানি যদি নবীজির কবর পাওয়ার হকদার হয়, তাহলে আটিবাজারবাসি কেন বঞ্চিত হবে?
আর মদিনায় কবরের কথা বলছো? মদিনায় কবর হওয়াই কি নবীপ্রেমের সর্বোচ্চ দলিল? পৃথিবীর কতোজন নবীপ্রেমিকের কবর মদিনায় আছে? রাসূল প্রেমিক হযরত সাইয়েদ আহমদ রেফায়ির জন্য কবর থেকে হাত বের করা যদি প্রেমের স্বীকৃতি হয়, তাহলে আল্লামা জামিকে স্বীয় কবরের কাছে যাওয়া থেকে বাধা দিয়ে নবীজি কীসের স্বীকৃতি দিলেন? আল্লামা জামী কি নবী প্রেমিক ছিলেন না? তোমার মনে বিরাট প্রশ্নÑহযরতের কবর কেন এই জনমানবহীন প্রান্তরে হলো- তাই না? ‘আচ্ছা বলো তো তৈরি ফুলবাগানে স্থান দখল না করে উশর প্রান্তরকে ফুলবাগানে রূপ দেওয়া কি সকলের জন্য সম্ভব? হযরত শাইখুল হাদীসকে দিয়ে আল্লাহ যদি মরুভূমিকে মরুদ্যানে পরিণত করতে চান, তাহলে তাতে তোমার এতো আপত্তি কেন?’ আমার মনের খটকা দূর হলো। হৃদয় শান্ত হলো।
কবরের অদূরে তারাবির জামাত
নতুন কবরের পাহারাদারি এবং যিয়ারতকারীদের কবর খুঁজে পাওয়ার সুবিধার্থে ইফতারির পর সিদ্ধান্ত নিলাম, কবরের অদূরে তারাবিহ পড়ে আজকের রাত হযরতের কাছে থাকার চেষ্টা করবো। সেমতে শাইখের দু’জন প্রিয়ছাত্র আটিবাজার মাদরাসার নাযেমে তালিমাতÑমাওলানা মুফতি মাহবুবুর রহমান ও হিফজ বিভাগের দায়িত্বশীল উস্তাদ মাওলানা আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ হিফজখানার ছাত্রদের নিয়ে কবরস্থানের দিকে রওনা হলাম। এশা-তারাবি শেষ করে বসে বসে ভাবছিলাম, একরাতের ব্যবধানে এখানে তারাবির জামাত অনুষ্ঠিত হবে, গতকালও এমন কথা কেউ বললে আমিই তার মস্তিস্কের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতাম; আজ সেই আমিই কিনা অনেকের সঙ্গে নামাজ পড়ছি। এটা কি শায়খুল হাদীসের কারামত নয়?-এর পরের দু’তিন রাতও এই আমল চালু থাকে। আলহামদুলিল্লাহ!
শাইখের মাকবারা ও এলাকাবাসী 
শাইখের লাশ মুবারক যখন কবরের দিকে নেওয়া হচ্ছিল, তখনি মূলত এলাকার মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তাদের সীমাহীন কৌতূহল- কে এই মহান সাধক?  যার জন্য বুক সমান নল-খাগড়ার দুর্গম পথে জীবন বাজি রেখে ছুটছে বনি আদম। তারা যখন প্রত্যক্ষ করলো, ঔদ্ধত্য নল-খাগড়া আর কাশবনের অনমনীয় মস্তকগুলো মুহূর্তের মধ্যে জমিনে নেমে এসেছে, তখনই তারা বুঝে নিল- আমরা কোনো পরশপাথরের সন্ধান পেয়ে গেছি। তারা যখন দেখল, কি সকাল কি বিকাল, কি আলো কি আধাঁর, কি ঝড় কি বৃষ্টি, সবকিছু উপেক্ষা করে পঙ্গোপালের মতো অসংখ্য বনি আদম ছুটে আসছে, তখনই তারা বুঝে নিল আমাদের ভাগ্যাকাশে সৌভাগ্যের তারকা উদিত হয়েছে।-এরপর থেকে এলাকাবাসী হযরতের প্রতি যে জজবা ও ভালোবাসা দেখিয়েছে- এককথায় তার কোনো নজির নেই। কীভাবে কবর পর্যন্ত ভালো রাস্তা হয়, আলো-বাতির ব্যবস্থা হয়, কী করে জিয়ারতকারীগণ কবর সহজে চিনতে পারে; তারা স্বউদ্যেগেই এসব ব্যবস্থা করতে আরম্ভ করলো। এখানেই শেষ নয়, কী করে এখানে নয়নাভিরাম মসজিদ হবে, আন্তর্জাতিক মানের মাদরাসা হবে এগুলো নিয়েও তাদের দৌড়ঝাঁপের শেষ নেই। এককথায় শাইখুল হাদীসের জন্য মৌখিক ভালোবাসাই নয়, তারা তাদের জান-মাল সবকিছু কুরবান করতে সদা প্রস্তুত।
কেরাণীগঞ্জের মানচিত্রে আজিজ নগর
বিগত ২৮ সেপ্টেম্বর রোজ শুক্রবার ঘাটারচর স্কুল ও শহীদনগর মাদরাসা সংলগ্ন স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। শাইখুল হাদীস ভক্ত স্থানীয় জনগণের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এই মাহফিল ছিল স্মরণকালের বৃহত্তম মাহফিলগুলোর অন্যতম। আটিবাজার অঞ্চলের সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে  এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে হযরত শায়খুল হাদীসের একান্ত ছাত্র মাওলানা সুলাইমান সাহেব ঘোষণা দিলেন, আজ থেকে শাইখুল হাদীসের কবর এলাকার নাম হবে আজিজ নগর। এই ঘোষণার সাথে সাথে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলীর মাঝে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি, দেশের অন্যতম মুরব্বি আল্লামা আশরাফ আলী সাহেব, মাওলানা আব্দুল হামীদ পীরসাহেব মধুপুর, হযরত মাওলানা হাফেজ মোহাম্মাদ ওমর সাহেব সাহেবজাদা সদর সাহেব হুজুর রহ.  আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী, আল্লামা মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা খোরশেদ আলম কাসেমী, মাওলানা মামুনুল হকসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম বয়ান করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক শাইখুল হাদীস কনফারেন্স উপলক্ষ্যে ভারত ও পাকিস্তান থেকে আগত ওলামায়ে কেরামদের মধ্যথেকে বংলাদেশে সফররত জামিয়া বিননূরিটাউন করাচির মুহতামিম আল্লামা মুফতি নাঈম সাহেব ও ভারতের বিধান সভার সম্মানিত বিধায়ক মাওলানা আতাউর রহমান মাঝারো ভূইয়াও বয়ান করেন। সঞ্চালনার দায়িত্ব থাকায় তিনটার পূর্বেই সভাস্থলে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি শাইখুল হাদীসের অসংখ্য ভক্তের পদচারণায় মুখরিত সভাস্থল। এলাকার সর্বস্তরের মানুষের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণে বিশাল প্যান্ডেল পরিপূর্ণ হয়ে জনস্রোত ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। বিদ্যুতের বারংবার আসা যাওয়া ছাড়া একটি অনুষ্ঠানের সকল সৌন্দর্যই এই মাহফিলে বিদ্যমান ছিল।
কবর সংলগ্ন নতুন মাদরাসা
মাহফিলের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পূর্বে হযরতের কবরের পাশে জামিয়াতুল আযীয-এর আজিজ নগর শাখার উদ্বোধন হয়। একজন আজিজুল হকের শাইখুল হাদীস হওয়ার পেছনে যার আবদান সবচেয়ে বেশি, বাংলার সেই সিংহপুরুষ আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরীর যোগ্য উত্তরসূরি আলহাজ হাফেজ মাওলানা মুহাম্মাদ ওমর সাহেব ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মাহফিল থেকে জামিয়াতুল  আযীযের জন্য ফাণ্ড সংগ্রহ করা হয়। ২০ থেকে ২৫ লক্ষ টাকার একটি ফাণ্ডের ওয়াদা লোকদের থেকে পাওয়া যায়। পাঠকদের থেকে কেউ এই কাজে শরিক হতে চাইলে জামিয়া রাহমানিয়ার মুহতামিম অথবা অন্য কোনো উস্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
শাইখের স্মরণে বাংলার মানুষ
হযরত শাইখুল হাদীসকে আল্লাহ তাআলা এমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা দান করেছেন যা এক কথায় অবর্ণনীয়। হুজুরের এন্তেকাল সংবাদ এদেশের সকল মিডিয়া গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে। ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী, উদারপন্থী, অনুদারপন্থী কেউ উপেক্ষা করার দুঃসাহস দেখায়নি। জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এবং সর্বোচ্চ সম্মান বজায় রেখে সংবাদ প্রচার করেছে।-এরপর থেকে প্রতিদিন সারাদেশের আনাচে কানাচে আলোচনা, স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুটি এবং সারাদেশে অসংখ্য আলোচনা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। হয়তো এধারা অব্যাহত থাকবে বহুদিন। কারণ এ জাতির প্রতি তার ঋণ শোধ হবার নয়।
পরিশেষে মহান রাব্বুল আলামিনের শাহি দরবারে করজোড় প্রার্থনা- ওগো মালিকে দু’জাঁহা! আমরা এই তুচ্ছ নগণ্য হতভাগারা তোমার ওই মকবুল বান্দার জন্য কী-ইবা চাইতে পারি। তোমার হাবিবের উম্মতি দাবিদার এই দীনহীনদের একটিই প্রার্থনা- তোমার এই বান্দার আমরণ স্বপ্ন ছিল, তোমার হাবিবের রওজার পাশে ঘুমানো। আমাদের জন্য অনেককিছুই অসম্ভব। কিন্তু তোমার জন্য সবই সম্ভব। তোমার এই বান্দাকে তোমার হাবিবের রওজার পাশে স্থান দিয়ে তার কলিজাকে শীতল করে দিয়ো। আল্লাহুম্মা আমীন।
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক! কলেবর বেড়ে যাওয়ায় হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর সঙ্গে আমার একান্ত কিছু স্মৃতি নিয়ে স্মৃতিচারণ সম্ভব হলো না। আল্লাহ তাওফিক দিলে বিষয়টি নিয়ে আগামীতে হাজির হব ইনশাআল্লাহ। 
 
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, ঢাকা

Powered by Create your own unique website with customizable templates.