• প্রথম পাতা
  • আরবী সাহিত্যে শাইখুল হাদিস সেমিনার
    • হযরত পাহাড়পুরী হুজুর দা: বা:
    • শাইখুল হাদিস আল্লামা আশরাফ আলী
    • মুফতি আব্দুল মালেক দা: বা:
    • মাওলানা আব্দুল মতিন বিন হুসাইন
    • মুফতি মাহফুজুল হক দা:বা:
    • মাওলানা শহিদুল্লাহ ফজলুল বারী ও উবায়দুর র
    • মাওলানা আব্দুল জব্বার দা: বা:
    • ড: শামসুল হক সিদ্দিকি দা:বা:
    • মাওলানা যায়নুল আবেদীন
  • শাইখুল হাদিস কনফারেন্স
    • উলামা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য প্রö
    • উলামা ওরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা-২
    • উলামা ওরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা-৩
    • হাফেজ উমর রহ:
    • শাইখূল হাদিস মামুনুল হকের ভাষণ
    • তারানা- সাঈদ আহমাদ
  • রাহমানিয়া ছাত্র কাফেলা স্মৃতি আলোচনা
    • স্মৃতি আলোচনায় মাওলানা মামুনুল হক
    • স্মৃতি আলোচনায় মুফতি সাঈদ আহমাদ
  • জীবনের বাঁকে বাঁকে
    • আব্বার শাসন ও সযত্ন অনুশীলন
    • আমার আম্মার কথা
    • লেখাপড়ার সুচনা
    • হযরত শামছুল হক ফরিদপুরীর সাহচার্য আমার জী
    • আমার তালিম ও তরবিয়াতে হযরত ফরিদপুরির দরদ ও &#
    • হযরত রফিক আহমাদ কাশ্মিরী রহ. এর কথা
    • হাদিসে রাসুল সা. এর প্রথম পরশ
    • দাড়িয়ে তব দুয়ার মাঝে
    • অধমের মাথায় হযরত থানভীর পাগড়ি
    • হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.
    • হুজুরের স্নেহের একটি নমুনা
  • সরাসরি সম্প্রচার
  • প্রধান কলাম সমূহ
    • বিদায় বাংলার শাইখুল হাদিস
    • উলামায়ে দেওবন্দের পতাকাবাহী
    • এক আল্লাহ ছাড়া কারো ভয় ছিল না
    • শাইখুল হাদিসকে যেমন দেখেছি
    • শাইখুল হাদিস রহ. স্মরণে
    • আমার জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক
    • হেফাজতে দ্বীনের জন্য শায়েখের আদর্শ গ্রহন 
    • শাইখুল হাদিসের স্মৃতিকথা, তাযকিরাতুল আজিö
    • শাইখুল হাদিস অনুদিত বুখারী শরীফ
    • জীবনের বেলাভূমিতে প্রিয়তম শাইখুল হাদিস
    • নবী প্রেমের কবি
  • জীবনউপলদ্ধি
    • তার জীবন আমাদের উপমা
    • ঘরে বাইরে শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক র
    • আদর্শ শিক্ষক যার শ্রেষ্ঠ পরিচয়
    • শাইখুল হাদিসের জীবনী পাঠ্য করা হোক
    • মওতুল আলেমি মওতুল আলমি
    • আজ আমি এতিম
    • অনন্য শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক
    • তিনি আমাদের বুখারীর ইমাম
    • আললামা
    • গন্তব্যে আমৃত্যু অবিচল
    • তিনি কোটি মানুষের প্রেরনা
    • দ্বীনের সফল মহানায়ক
  • গবেষনা
    • হকের উপর অটল এক ব্যক্তিত্ব
    • অসাধারন গুনাবলীর অপূর্ব সমাহার
    • হাদিস চর্চায় কালজয়ী অবদান
    • আমার দেখা শাইখুল হাদিস
    • তিনি কেন অসাধারণ
    • ঈমানদীপ্ত এক বীরের গল্প
    • রহমানিয়া ও শাইখুল হাদিস রহ.
    • আপনি ঘুমাতে পারেন না
    • রাজনীতিবিদ শাইখুল হাদিস
    • বাবরী মসজিদ লংমার্চ
  • অনুভূতি
    • আমার অনুভূতি
    • দীনের দরদী খাদেম
    • তার সাথে আমার জীবনাচার
    • শাইখুল হাদিসকে যেমন দেখেছি
    • হাদিসের দিকপাল
    • মহানুভবতার উজ্জল দৃষ্টান্ত
    • ইলম ও আমলের প্রানময় বটবৃক্ষ
    • স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
    • শাইখুল কুরআন
    • আদর সোহাগে গড়েছেন এক আদর্শ পরিবার
    • যে রত্ন আজ হারিয়ে খুজিঁ
  • স্মৃতি আলোচনা
    • প্রিয় রাহবারের শবযাত্রার মিছিলে ৩০ ঘন্টা
    • কতো স্মৃতি কতো কথা
    • সুযোগ পেলেই তার কপালে চুমু খেতাম
    • স্মৃতির পাতায় শাইখুল হাদিস
    • যার জিকিরে গুন্ঞ্জরিত মাদরাসা
    • শাইখুল হাদিস জিন্দাবাদ নয়
    • স্মৃতিগুলো জেগে থাকে মনে
    • স্মৃতি ও স্বপ্ন
    • স্মৃতিতে শাইখুল হাদিস
    • স্মৃতিগুলো এলোমেলো
    • মনের মুকুরে
    • সবই আছে শুধু নানাজি নেই
    • স্মৃতির পাতায় শাইখুল হাদিস
  • একান্ত সাক্ষাতকারে শাইখুল হাদিস
  • শাইখুল হাদিসের বৈচিত্রময় জীবন-সাধনা
    • বংশ ও পূর্ব পুরুষ
    • জন্ম ও শৈশব কাল
    • শিক্ষা জীবন
    • উল্লেখযোগ্য শিক্ষকবৃন্দ
    • শিক্ষকতা
    • রচনা ও সংকলন
  • স্মৃতি তারানা
    • তুমি সত্য ন্যায়ের বাতি
    • এতিম হলো দেশ
    • তার বিদায়ে কেঁদেছে মানুষ
  • ছবি গ্যালারী


আল্লামা আজিজুল হক রহ. ও আমার অনুভূতি
মুফতী ওমর ফারুক সন্দ্বীপী

আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ওয়াসসালামু আলা আশরাফিল আম্বিয়ায়ি ওয়াল মুরসালিন। ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহী আজমাঈন। আম্মাবাদ।
এ জীবনে যে ক’জন মানুষকে প্রাণভরে শ্রদ্ধা করেছি, মনের গহিন থেকে ভালোবেসেছি। তাদের মধ্যে একজন শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। ভারতে লেখাপড়ার প্রাক্কালে সে যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ শায়খুল হাদীস মাওলানা জাকারিয়া রহ.-এর দীর্ঘদিন খেদমতের সুযোগ পেয়েছিলাম। হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ. এর দৌহিত্র হযরত মাও. আশরাফ আলী থানভী রহ. এর স্বনামধন্য খলীফা, দারুল উলুম দেওবন্দের অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ের মহাপরিচালক হযরত মাওলানা ক্বারী তৈয়্যব সাহেব রহ.-এর খেদমত করার অনেক দিন সুযোগ হয়েছিল। মূলত এসব সৌভাগ্যের ব্যবস্থা হয়েছিল আমার প্রাণপ্রিয় উস্তাদ, বর্তমান বিশ্বের স্বনামধন্য আলেমে দীন, দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী দা.বা. এর অনুগ্রহে। এই সব মনীষীদের মতো খুব কাছের থেকে এই লৌহমানবকে আমি দেখেছিলাম। স্বল্প সময়ের পরিচিত এই লৌহমানব আমার স্মৃতির মানসপটে খুব উজ্জ্বল একজন ব্যক্তিত্ব। আমি তাকে প্রথম সাক্ষাৎ থেকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসতে শুরু করি। তার জীবনীর আলোচনার জন্য লিখিত স্মারক গ্রন্থে আমার ন্যায় দীনহীনের কোনো লেখা থাকবে তা কল্পনাও করিনি। তবুও লিখতে হলো তাকে ভালোবাসি বলে। 
আল্লাহ্ আমার এই লেখাতে বরকত দিন- আমিন 
অলিকুল শিরোমণি আওলাদে রাসূল সা. হযরত মাওলানা স্যাইয়্যেদ আস’আদ মাদানির ইন্তেকালের পর তার স্মারকের লিখা জীবনের প্রথম আমার লিখা। দ্বিতীয়বার চরমোনাইর কুতুবের স্মারকের জন্য কলম ধরেছিলাম। পর পর মাওলানা সামসুদ্দিন কাসেমী রহ. ও আল্লামা নূরুদ্দিন গওহরপুরী রহ. এর স্মারকের জন্য লিখতে হয়েছিল। আর আজ এ মহান ক্ষণজন্মা মনীষীর জন্য আবার কলম ধরলাম।
মেশকাত শরিফে বর্ণিত, রাসূলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমার উম্মতের মধ্য হতে একদল লোক সর্বদাই দীনের (হকের) ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তিরস্কারকারীদের তিরস্কার তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (মিশকাত পৃ: ৫৮৪) রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপরোক্ত বাণীটি অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে এবং কেয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিফলিত হতে থাকবে। ইনশাআল্লাহ্।
যদি প্রশ্ন করা হয় হাদিস শরিফে প্রশংসিত ওই দলটি কারা? জবাবে বলা হবে, যারা হক ও হক্কানিয়্যাতকে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করার বেলায় ছিলেন সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় মজবুত। বাতিলের মোকাবেলায় ছিলেন নির্ভীক, মর্দে মুজাহিদ। কস্মিনকালেও বাতিল ও খোদাদ্রোহীদের সামনে শির নত হয়নি যাদের। ক্ষণস্থায়ী বস্তুর লোভ-লালসা, ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা আর জুলুমের ভয়, সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসের আতঙ্ক ক্ষণিকের জন্যও যাদেরকে পদচ্যুত করতে পারেনি। তারা মৃত্যুর আঁধারে গিয়েও অমর, তারা হলেন হযরত আম্বিয়া আ., সাহাবায়ে কেরাম রা., শুহাদায়ে ইযাম, সিদ্দীকীন, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আইম্মায়ে কেরাম, সুলাহা-ফুকাহা, মুহাদ্দিসীন-মুফাস্সিরীন, হাক্কানী-রাব্বানী উলামায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে ইযাম প্রমুখ। তারা ক্ষণজন্মা হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সেই ক্ষণজন্মা মনীষীদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। তিনি ছিলেন সততা, সাহসিকতা, , আন্তরিকতা, একনিষ্ঠতা, নৈতিকতা, আমানতদারি-দিয়ানতদারি, ইহসান ও তাকওয়া ইত্যাদির এক মূর্তপ্রতীক। মরহুম একদিকে ছিলেন আল্লাহ তা’আলার শাহি দরবারের মুখাপেক্ষী। অপরদিকে সৃষ্টিজগৎ থেকে ছিলেন সম্পূর্ণ বিমুখ। তাকে দেখতে অত্যন্ত সাদাসিধে সহজ-সরল মনে হতো। তবে কর্মক্ষেত্রে দেখা যেত তিনি সিদ্দিকে আকবরের বিপ্লবী আদর্শের অনুসরণকারী। তার সমসাময়িক গুণীজনরাও তার দরবারে এসে তার দেয়া কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানাতেন। এমন ঘটনা আমার জীবনে অনেকবার দেখেছি। তার প্রত্যক্ষ উদ্যোগ, উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং সর্বাত্মক সহযোগিতায় সারা দেশে বহু ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তিনি ছিলেন ইবাদত-বন্দেগির প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপকারী একজন সুফী সাধক। আল্লাহর রেজামন্দীর ওপর নিজেকে সোপর্দকারী ইত্তেবায়ে সুন্নাতের দৃপ্ত প্রতীক। শিরক্ গোমরাহি ও কুসংস্কারের মুখোশ উন্মোচনকারী। আকাবিরে দেওবন্দের নকশে কদমের প্রতীক।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. এর চল্লিশ বছর বয়সে ইন্তেকাল হয়। ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রহ. এর ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে, ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর চুয়ান্ন বছর বয়সে, ইমাম গাযালী রহ.এর পঞ্চান্ন বছর বয়সে, ইমাম নববী রহ.-এর পঁয়তাল্লিশ বছর  বয়সে। ইমাম আবু বকর হাযেমি রহ. ছত্রিশ বছরে, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ. ঊনপঞ্চাশ বছরে ও মাওলানা আব্দুল হাই লাখনবি রহ. ঊনচল্লিশ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। এ সকল মনীষী অল্প সময়েই পৃথিবীতে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করেন। তাদের কালোত্তীর্ণ কীর্তির বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন জগতের শত শত লেখক ও সাহিত্যিক। কালে কালে পৃথিবীর সুশীল সমাজ তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন এবং অনাগত কালেও করতে থাকবেন। শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ছিলেন এ ধারারই একজন।
সন্দ্বীপের পীর আলহাজ হযরত মাওলানা ইদ্রীস সাহেব রহ.-এর ২০০২ সালে ইন্তেকালের পর তার প্রতিষ্ঠিত দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানি নগর। মাদ্রাসার কঠিন ক্রান্তিলগ্নে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের বার বার অনুরোধ আর চিঠি পত্রের আদান প্রদানের সুবাদে প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে মক্কা-মদিনার পরিবেশ ত্যাগ করে দেশের ব্যস্তময় জীবনে এসে কর্তব্যের অক্টোপাসে যখন জড়িয়ে পড়লাম তখন এক পবিত্র বিকেলে এই মহা মনীষীর সাথে আমার দ্বিতীয়বার সাক্ষাত হয়। প্রবাস জীবনে বহুবার তার নাম শুনেছি। দু’চার বার বয়ানের ক্যাসেটও শুনেছি। বয়ানের ধারাবাহিকতার একপর্যায়ে চোখ থেকে গোপনে পানিও ঝরেছে। এত সুন্দর করে মানুষকে তিনি জাহান্নামের ভয়াবহ আজাবের কথা শুনিয়েছেন। কবরের ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা শুনিয়েছেন। মউতের সীমাহীন কষ্টের কথা শুনিয়েছেন, হাশরের ময়দানের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার মিনতি করেছেন। আবার জান্নাতের নেয়ামতের কথা বলে, জান্নাতের আরাম-আয়েসের কথা বলে, মাওলার মহব্বতের কথা বলে নেক কাজের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার দরদি হৃদয়ের এই কথাগুলো আমাকে খুব আকর্ষণ করত। তার মাঝে আমার শ্রদ্ধেয় আপন জনের সুঘ্রান পেতাম। আমার স্মরণীয় স্মৃতির মানসপটে আঁকা তার সাথে সাক্ষাতের প্রথম ঘটনা নিম্নরূপ ছিল।
১৯৭৮ সালের কথা দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে সবেমাত্র লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরেছি। আসার পর ঐ বৎসরই হজে যাচ্ছিলাম। বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে আমার দু’পাশে দু’জন মহান ব্যক্তিত্ব উপবিষ্ট ছিলেন। একজনের জবান মোবারক অনবরত কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল। আরেকজন গুণ গুণ করে কিছু আরবি কবিতা আবৃত্তি করছেন। একজনের জবান থেকে কুরআনের নূর বিচ্ছরিত হচ্ছে, আরেকজনের জবান থেকে ইশ্কে রাসূল সা. এর নূর বিচ্ছরিত হচ্ছে।
ইতিমধ্যে হাজিদের মধ্যে জোহরের নামাজ পড়া নিয়ে মতবিরোধ হলো। কেউ বলছিলেন- বিমানে নামাজ পড়বেন, কেউ বলছিলেন জিদ্দা বিমান বন্দরে অবতরণের পর নামাজ পড়বেন। আমার বামপাশে যিনি উপবিষ্ট ছিলেন, আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, মাওলানা লোকদেরকে তালবিয়া পড়ান, আর মাসআলা বলে দিন, জিদ্দাতে অবতরণের পর জোহর নামাজের জন্য ২ ঘণ্টার ওপরে সময় থাকবে। সেখানে পৌঁছে শান্তিমতো নামাজ পড়া যাবে। আর বলে দিবেন হাফেজ্জী হুজুর জাহাজে আছেন। তিনি জিদ্দা বিমান বন্দরে অবতরণের পর নামাজ পড়বেন। আমি জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তার নূরানী চেহারার দিকে তাকালাম। বললেন- আমার নাম আজিজুল হক।
আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। আমার ন্যায় নগণ্য খাদেম ও গোলাম হাফেজ্জী হুজুর আর শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেবের মাঝখানে বসার সুযোগ পেয়েছে। যাদের নাম কতো শুনেছি। আজ তাদের এতো কাছে। মনে মনে পুলকিত হলাম। নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করলাম। হযরতের নির্দেশমতো আমি বিমানের ককপিটের দিকে গেলাম। তারা আমাকে স্পিকার হাতে দিল। মনভরে লাব্বাইক পড়ালাম। লাব্বাইকের গুঞ্জনে যখন সবাই বিমোহিত তখন হযরত শায়খুল হাদিসের বাতানো মতে মাসআলা বলে দিলাম। যাত্রীরা শান্ত হলেন।
বার বার তার এ কথা আজও পর্দায় ভেসে ওঠে। মন বিমোহিত হয়। চোখ কান্নায় ভেসে যায়। তার মতো এতো বড় মাপের মানুষ, আমার মতো একজন নগণ্য খাদেমকে জীবনের প্রথম সাক্ষাতে এত মূল্যায়ন করলেন তা চিন্তা করে, তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে যায়। স্মৃতির মানসপটে খুব উজ্জ্বল এই ব্যক্তিত্বকে প্রথম সাক্ষাতে ভালোবেসে ফেলি। এ জগতে এমন মাটির মানুষ হয়তো আর দেখবো না। তিনি কেবল মাটির মানুষ ছিলেন না, অন্যায় অপরাধ আর বিদআত-শিরকের বিরুদ্ধে তিনি লৌহমানব ছিলেন। বাতিল আর ভণ্ডদের ভণ্ডামি নস্যাৎ করার জন্য তার মতো সাহসী ভূমিকা বাংলার জমিনে আর কতজন রেখেছেন আমার জানা নেই। 
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন যে উদ্দেশ্যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যুগে যুগে বিশেষ কিছু মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। তারা মানুষ হলেও সাধারণ মানুষ নন, তারা মহামানব। তাদের কর্ম ও চিন্তার জগৎ অসাধারণ। তাদের সাথে সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামিনের সম্পর্ক ভিন্ন রকম। তাদের দায়িত্ব ও কর্মপরিধি বিশাল ও ব্যাপক। তাদের শক্তি এবং ক্ষমতাও বিশাল।
আম্বিয়ায়ে কিরাম হলেন সেই বাছাইকৃত বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মহামানবদের মাঝে শ্রেষ্ঠতম। অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম; এরপরই হলেন আউলিয়ায়ে কিরাম। আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর নবীযুগের অবসান হয়েছে। পৃথিবীতে আর কোনো নবী আসবেন না। সাহাবা যুগেরও অবসান ঘটেছে প্রায় ১৪-শত বছর পূর্বেই। তবে আম্বিয়া ও  সাহাবায়ে কেরামের অবর্তমানে আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলার যে প্রিয় বন্ধুরা বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন, তারাই হলেন আউলিয়ায়ে কিরাম।
মহান রাব্বুল আলামিনের এই বিশিষ্ট ও প্রিয় বন্ধুগণ কেয়ামত পর্যন্ত বিভিন্ন যুগে পৃথিবীর নানা প্রান্তে তাশরিফ আনবেন। তারা মানুষকে আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলার পথ দেখান। রাসূলুল্লাহ সা. -এর আদর্শ শেখান। দীনের আলো প্রজ্বলিত রাখেন। মানবতার মুক্তির দিশা দেন।
আম্বিয়ায়ে কিরামের মাঝে যেমন বিভিন্ন মরতবা ও স্তর রয়েছে তেমনি আউলিয়ায়ে কেরামও বিভিন্ন স্তরের হয়ে থাকেন। নবীগণের মরতবা ও মর্যাদা অনুযায়ী দায়িত্বের পরিধি নির্ধারিত ছিল। যেমন কোনো নবী শুধু তার গোত্রে দীনের দাওয়াত দিয়েছেন। কোনো নবী দাওয়াতি কাজ করেছেন শুধু নিজের জাতির মাঝে। আবার অনেক নবী দায়িত্ব পালন করেছেন নির্দিষ্ট একটি এলাকায়। বিশিষ্ট নবীগণ দায়িত্ব পালন করেছেন দুনিয়াব্যাপী। যেমন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. -এর মিশন ছিল বিশ্বময়। এ জন্যই তিনি বিশ্বনবী।
আউলিয়ায়ে কিরামের মাঝেও তাদের মরতবা ও মর্যাদার আলোকে প্রভাব সৃষ্টি হয়ে থাকে। আল্লাহর অনেক অলি এমনও থাকতে পারেন, মানব সমাজে যার প্রকাশই ঘটেনি। শুধু আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলাই জানেন তার সেই প্রিয় বন্ধুর কথা। আবার অনেক অলিয়ে কামেল এমনও হয়ে থাকেন, যাদের কার্যক্রম ও দাওয়াতের প্রভাব বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ যুগ যুগ ধরে যাদেরকে স্মরণ করে। যাদের আদর্শ, শিক্ষা ও জীবনধারা তাদের অবর্তমানেও মানুষ অনুসরণ করে। 
যেমন- শাহ্ আব্দুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী রহ., শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ., শাহ্ আব্দুল আজিজ দেহলভী রহ., হাজী এমদাদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কী রহ., শাহ্ কেরামত আলী জৈনপুরী রহ., শাহ্ সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহ., কুতুবুল আলম রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ., মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ., হাজী শরীয়ত উল্লাহ্ রহ., হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ., শাইখুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী রহ., ফুরফুরার মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী রহ., হযরত মাওলানা ইলিয়াস দেহলভী রহ., মুজাহিদে আযম শামছুল হক ফরিদপুরী রহ., শাহ্ মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী রহ. সন্দ্বীপের পীর আলহাজ্ব হযরত মাওলানা ইদ্রিস সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহিম আজমায়ীন। এরা হলেন বিশ্বময় প্রভাব সৃষ্টিকারী অলীয়ে কামেল। এ উপমহাদেশে আমরা ইসলামের সুশীতল ছায়া পেয়েছি তাদেরই মেহনতের বদৌলতে।
এমন আরও অনেক নাম জানা-অজানা অলি রয়েছেন, যাদের প্রভাব ও খ্যাতি দুনিয়াব্যাপী। যারা হাজার হাজার এমনকি লাখো অনুসারী ও ভক্ত সৃষ্টি করেছেন। অগণিত আলেমে দীন, মুবাল্লিগ, মুহাদ্দিস ও ফকীহ্ তৈরি করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দীনের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। দীন ইসলামের সঠিক দাওয়াত এবং রাতূলুল্লাহ্ সা.- এর সুন্নাত তাওহিদ, রিসালাত, ইবাদত, সিয়াসাত ও মুয়ামালাত- মুয়াশারাতসহ ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়ের ওপর কিতাব, রিসালা ও মাওয়ায়েজ রেখে গেছেন।
হাদিস, তাফসির, ফিকাহ্, তারিখ, হেকমত, ফালসাফা (ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন) উসূল ও আকায়েদের ওপর তারা যে সমৃদ্ধ গ্রন্থরাজি উম্মাহ্র জন্য রেখে গেছেন, তা বলতে গেলে এক মহাবিস্ময়।
পৃথিবীতে একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মে এমন মহামূল্যবান ও শক্তিশালী সম্পদ নেই। এক কথায় আউলিয়া ও আম্বিয়ায়ে কিরাম তাদের অতুলনীয় অনুসন্ধান-গবেষণা এবং চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ্র জন্য এমন সম্পদের প্রাচুর্য ও শক্তির উপাদান রেখে গেছেন, যার যথাযথ অনুশীলন ও প্রয়োগ ঘটালে বিশ্বের তাবৎ মানবসভ্যতা তাদের পদানত হতে বাধ্য।
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এই মুবারক কাফেলারই একজন। হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র মাকাম কোন পর্যায়ের তা কেবল তার সমপর্যায়ের মহান ব্যক্তিরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে যেহেতু উল্লিখিত আকাবিরে উম্মত এবং আউলিয়ায়ে কিরামের সাথে এই মহাপুরুষের ব্যক্তিচরিত্র, তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন, তার আধ্যাত্মসাধনা এবং মানবতা ও দীনের তরে তার বিস্ময়কর অবদানের এক চমৎকার সামঞ্জস্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। তাই তাকেও স্বাভাবিকভাবেই আমরা এই মহান আউলিয়া পরিবারের এক জ্যোতির্ময় নক্ষত্র মনে করতে পারি।
একজন শাইখুল হাদীস হয়ে দীন ইসলামকে জীবনের সকল পরিমণ্ডলে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠার যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তিনি চালিয়ে গেছেন- তা শুধু বাংলাদেশে নয় বরং ইতিহাসে এক অনন্য কীর্তি।
দীনের এমন কিছু আবশ্যকীয় বিষয়কে তিনি পুনরুজ্জীবিত করেছেন, বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্র ও অবহেলায় যা প্রায় বিলীন হতে চলেছিল। এমন কিছু ফেৎনা তিনি মোকাবেলা করেছেন, যা মুসলমানদের দীন ও ঈমানের জন্য চরম হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল। এমন কিছু বিষয়ে তিনি মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, যা মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বাকে সংকটাপন্ন করে তুলেছিল।
তিনি মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে মনুষ্যত্ববোধকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। মানুষের অন্তরে লুকিয়ে থাকা পশুত্বকে দমন করে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন ইনসানে কামেল গড়ে তোলাই ছিল তার জীবন সাধনার প্রধান লক্ষ্য। তিনি শিশুশিক্ষা, ধর্মীয় গণশিক্ষার ক্ষেত্রে এক নব দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।
তিনি দীনের জন্য যেমন ভেবেছেন তেমনি দেশ ও জাতির জন্যও তার ভাবনার অন্ত ছিল না। এ দেশের ইসলামি রাজনীতিতে তিনি এক আপোসহীন ধারা সৃষ্টি করেছেন। জাহেলি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার চরম পঙ্কিল পরিবেশেও তিনি এমন এক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছেন, যা থেকে ইসলামের প্রাথমিক যুগের খুশ্বু পাওয়া যায়। এক কথায় ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, উম্মাহ্র স্বার্থে যে ব্যাপক অবদান তা ইসলাম ও মানবতার পক্ষে এক বিশাল সংযুক্তি। তার এই বিশাল কীর্তি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে এবং নব প্রজন্মকে দীনের সহীহ্ পথে উজ্জীবিত করতে এই মহান বুুযুর্গের জীবন-কর্ম, দর্শন-চিন্তা ও আদর্শ ব্যাপকভাবে প্রচার, গবেষণা ও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। তার নামে প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থটি এই প্রয়োজন পূরণে অনেকটা অবদান রাখবে বলে আমি আশাবাদী।
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর আনুমানিক ৯৪ বছরের কর্মময় ও সংগ্রামী জীবন এক বিস্ময়কর উপাখ্যান। একজন আলেমে দীন হয়ে, একজন আত্মার চিকিৎসক হয়েও তিনি যে বহুমাত্রিক খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, তা অসম্ভব না হলেও ইতিহাসে বিরল।
তিনি পথভোলা মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি ও নৈতিক সমৃদ্ধির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা যেমন চালিয়েছেন, তেমনি শিরক, বেদআত ও ভণ্ডামির মোকাবেলা করেছেন। তিনি গণমানুষের মুক্তির জন্যে, অধিকার আদায়ের জন্যে রাজপথে আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছেন। আবার শিক্ষা সংস্কারেও আত্মনিয়োগ করেছেন; তা’লীম তারবিয়্যাত দিয়েছেন।
তিনি মানুষের মাঝে ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। ওলামায়ে কিরামকে এক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যেকোনো সংকটে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সর্বাগ্রে। তিনি ছিলেন দেশ, জাতি ও উম্মাহ্র জন্য এক জাগ্রত বিবেক। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে তিনি কাজে লাগাতেন। সময়সচেতনতা ছিল তার বিস্ময়কর জীবনের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
বছরের প্রায় দিনই তার প্রোগ্রাম থাকত। তারপরও ওয়াদা করে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি, এমন ঘটনা তার জীবনে কখনো ঘটেনি।
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ছিলেন দীনের একজন অক্লান্ত দা’য়ি। ক্লান্তিহীনভাবে তিনি দিনের পর দিন বছরের পর বছর ইসলামের পথে আল্লাহ্ ও তার রাসূলের পথে, কুরআনের পথে, সত্য ও ন্যায়ের পথে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি মুসলমানদেরকে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করতে বলতেন। তিনি দীনের পূর্ণাঙ্গ ধারণা প্রকাশ করতেন। পূর্ণাঙ্গ দাওয়াত দিতেন। এক বুক দরদ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ দীনের সাধনাই করেছেন তিনি আজীবন। দীন এবং দুনিয়াকে আলাদা করার সুবিধাবাদী প্রবণতাকে তিনি বরদাশ্ত করতেন না। দীন এবং দুনিয়াকে আলাদা করার প্রবণতা থেকেই আজ ইসলামকে রাষ্ট্র থেকে, সমাজ থেকে, অর্থনীতি থেকে, সংস্কৃতি থেকে বিদায় করার চেষ্টা চলছে। অথচ এসব কিছুই দীন তথা ইসলামের বিষয়বস্তুর বাইরে নয়। কিছু উপাসনা আর আরাধনার মধ্যেই শুধু যারা ইসলামকে গন্ডীবদ্ধ মনে করেন; হযরত মাওলানার দাওয়াত তাদের জন্য উত্তম শিক্ষা হতে পারে। কারণ, তিনি একজন উত্তম আবেদ এবং অসাধারণ সাধক ছিলেন। তার জীবনে কোনো নামাজ কাজা হয়নি। এমনকি কোনো ফরজ নামাজের জামাতও তার জীবনে ছোটেনি। তার জবানে সবসময় জিকির চালু থাকত। মা'রেফতের এক বিশেষ স্তরে তিনি ছিলেন। তবু তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ইসলামের আলোকে গড়ে তুলতে। তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন জীবনের সকল পর্যায়ে এবং এ সংগ্রামকে তিনি উত্তম এবাদত মনে করেছেন।
ইসলামের পূর্ণাঙ্গ দাওয়াত নিয়ে তিনি পাগলের মতো ছুটেছেন দেশে দেশে, গ্রামে গ্রামে। এমন একজন নির্ভীক অক্লান্ত দায়ি এদেশের মানুষ খুব কমই দেখেছে। আর দাওয়াতের এমন হৃদয়গ্রাহী আবেদন, এমন কান্নাঝরা নিবেদন খুব কম মানুষই শুনেছে। তার দরদমাখা দাওয়াত যারা পেয়েছে, খুব কম মানুষই তা প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছে। খুব কম চোখই পানি সম্বরণ করতে পেরেছে। তার কান্নাভেজা দাওয়াত মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছে।
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর জীবনের প্রায় অর্ধাংশই ছিল সফরসূচিতে বন্দী। সফরসূচির আলোকে তিনি ছুটে বেড়াতেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। বাৎসরিক সফরসূচির আলোকে এবং স্থানীয় পর্যায়ে আবার দিন ও রাতের প্রতি ঘণ্টার প্রোগ্রামসূচি সাজানো হতো। এরই মাঝে আবার থাকত সাধারণ মানুষের সাথে সাক্ষাত। ভক্ত অনুসারীদের দোয়া ও পরামর্শ কামনা।
তিনি এমনই এক ব্যস্ত মুসাফির ছিলেন যে, ভক্ত অনুসারীরা কোথাও তাকে তৃপ্তিরে দেখার সুযোগ পেতেন না। অন্যত্র যাওয়ার সময় হয়ে যেত। এতো সফর, এত  প্রোগ্রামের পরও মনে  হতো আরও যেন কতো কাজ বাকি। সাথী-সঙ্গীরা ক্লান্ত-শ্রান্ত তিনি নির্ভীক মহা প্রশান্ত। এ এক বিস্ময়কর মুসাফিরের জীবন। লাগাতার দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বাংলার পথে প্রান্তরে, মাঠে-ঘাটে, শহর-বন্দরে। এমন সফরও কি মানুষের পক্ষে সম্ভব! এটা কি তাহলে আল্লাহর এই প্রিয় বন্ধুর কারামত! আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলাই ভালো জানেন।
তিনি এমন এক ছায়াদার বৃক্ষ ছিলেন, যার ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করতো লক্ষ লক্ষ আশ্রয়হীন মানুষ। তাকে কেন্দ্র করে মানুষের আশা আকাক্সক্ষা আর স্বপ্ন আবর্তিত হতো। তিনি যেমন সমষ্টিগতভাবে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অভিভাবক ছিলেন, তেমনি অভিভাবক ছিলেন এই রুহানী পরিবারের প্রতি সদস্যের।
একজনের হালের গরু কেনা প্রয়োজন- তাও জিজ্ঞেস করতেন শাইখের কাছে। মেয়ে বিয়ে দিতে হবে, পরামর্শ নিতেন শায়খ হতে। ছেলে কথা শুনে না, বিবি পর্দা করে না- নালিশ করতেন শাইখের কাছে। অপর সাথী ভাই-এর সাথে মনোমালিন্য হয়েছে; অনুযোগ জানাতেন তার কাছে।
এ ছিল এক ভালোবাসার বন্ধন, এক প্রাণের খেলা। তিনি সবার কথা শুনতেন। ধৈর্য ও মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন,  দোয়া দিতেন। ভক্ত অনুসারীর হৃদয়মন আনন্দে নেচে ওঠত। কাউকে তিনি ধমক দিলে সে নিজেকে খোশ নসিব মনে করতো। এ যুগে কোথায় পাওয়া যাবে এ দৃশ্য? নবী যুগের পর খুব কমই মিলেছে এমন প্রাণের মেলা, মহাব্বতের মেলা।
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ছিলেন একজন আপোসহীন সাহসী মুজাহিদ। বাতিল আর খোদাদ্রোহী শক্তি যতো শক্তিশালী আর প্রতাপশালীই হোক- তিনি প্রতিবাদ প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন নির্ভীক চিত্তে। দীন আর দেশ বিরোধী যেকোন ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলায় তিনি ছিলেন সদা উচ্চকণ্ঠ। দেশে কিংবা বহির্বিশ্বে যেখানেই যখন ইসলামের ওপর, আল্লাহ-রাসূল সা.-এর ওপর, কুরআনের ওপর কিংবা মুসলিম উম্মাহ্র উপর আঘাত এসেছে, তিনি এর প্রতিবাদে গর্জে ওঠেছেন, আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। দীন ও শরীয়তের প্রশ্নে তিনি কখনো আপোস করেননি, ছাড় দেননি বিন্দুমাত্র।
তার আন্দোলন চলেছে একযোগে ধর্মীয় ভণ্ডামি আর রাজনৈতিক ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। কাদিয়ানি ফেৎনা, মওদূদি ফেৎনা, দেওয়ানবাগি ফেৎনা, রাজারবাগি ফেৎনা আর ধর্মের নামে নব্য সন্ত্রাসী ফেৎনার বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ আপোসহীন ভূমিকা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠিত শক্তি চোখ রাঙিয়েছে, হুমকি-ধমকি দিয়েছে, জেলও খেটেছেন, কিন্তু তিনি তার মিশন থেকে বিচ্যুত হননি। সত্য উচ্চারণে এবং মিথ্যার বিরুদ্ধাচরণ থেকে তিনি কখনো বিরত থাকেননি। প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রশক্তি আর শিরক বিদ্আতের বিরুদ্ধে তিনি যে লড়াই করেছেন, তা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রায় ৫ শত বছর পূর্বে রচিত শায়খ আহমদ মুজাদ্দেদে আলফে সানীর সংস্কার আন্দোলনের কথা।
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ছিলেন একজন নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিক। প্রচলিত ধারার ক্ষমতা বদলের রাজনীতি তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন- ‘প্রচলিত পদ্ধতিতে কেয়ামত পর্যন্তও যদি ক্ষমতার হাত বদল হয়, তবুও জনতার মুক্তি আসবে না।’ তিনি নীতির পরিবর্তন চেয়েছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ও সাংবিধানিক পদ্ধতির পরিবর্তন চেয়েছেন। তিনি বলতেন- ‘শুধু নেতার পরিবর্তন আর ক্ষমতার হাত বদল হলেই শান্তি আসবে না, বিগত দিনে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই আমরা বহুবার তার প্রমাণ পেয়েছি।’
তিনি বারবার বলেছেন- ‘আকাশ জমিনের মালিক যেমন আল্লাহ্, জীবন-মৃত্যুর মালিক যেমন আল্লাহ্, ক্ষমতা-রাজত্ব আর সম্পদের মালিকও তেমনি আল্লাহ্। আর শান্তির মালিকও আল্লাহ্। অতএব শান্তি পেতে হলে মানুষের গড়া দুর্বল নীতি বাদ দিয়ে আল্লাহর নীতিতে দেশ চালাতে হবে।’
হযরত মরহুমের এই পদ্ধতি ও নীতির পরিবর্তনের ব্যতিক্রম রাজনীতি সপ্তদশ শতকের দার্শনিক শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভীর সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের বিপ্লবী আওয়াজেরই প্রতিধ্বনি ছিল।
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. সর্বদাই মুসলমানদের ঐক্য কামনা করতেন। ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহ ছিল তার জীবনের একটি বড় স্বপ্ন। তিনি এদেশের ওলামায়ে কিরামের মাঝে ঐক্য গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন এবং হক্কানি ওলামা-মাশাইখের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে হযরত রহ. সম্মুখ সারিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি রাজনীতিতেও কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতেন। নিজে যেমন কখনো নিয়ম লংঘন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেননি, তেমনি অন্য কেউ নিয়ম লংঘন বা ওয়াদা ভঙ্গ করলে তিনি তা মেনে নিতে পারতেন না।
তিনি সব সময়ই ছিলেন আশাবাদী। কোনো পরিস্থিতিতেই তিনি হতাশ ও পেরেশান হতেন না। জীবনের প্রতিা মুহূর্তেই তিনি ছিলেন সক্রিয়, উদ্যমী ও উজ্জীবিত। তার আশাবাদী প্রেরণা আর গতিময়তা মুসলমানদের মনে সাহস আর উৎসাহের জন্ম দিত। তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন আদর্শ মুরব্বি ছিলেন।
সুশিক্ষাই মানুষকে আলোকিত করে, সত্যের পথ দেখায়। আর শিক্ষার সাথে নৈতিক দীক্ষার সমন্বয় না হলে একজন শিক্ষিত মানুষ থেকেও পশুত্ব প্রকাশ পেতে পারে। নৈতিকতাহীন বৈষয়িক শিক্ষা সমাজের জন্য কল্যাণকর না হয়ে অনেক সময় অকল্যাণের কারণ হয়। এসব চিন্তা থেকেই হযরত রহ. শিক্ষা সংস্কারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এজন্য তার জীবনের বিরাট অংশ ব্যয় হয় বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পৃষ্ঠপোষকতায়। কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির জন্য তার কুরবানি ও পরিকল্পনা সোনার অক্ষরে লিখে রাখার মতো। এই উদার মানুষটির আন্তরিকতা ও নিরলস  খেদমতে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড তার স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা এবং মৌলিক ধর্মীয় শিক্ষাদানের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য বাস্তবায়নে হযরত এর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার কুরআনী মক্তব চালু করে শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া। বিদেশি এন.জি.ও. এবং বিজাতীয় মিশনারীর খপ্পর থেকে এদেশের সন্তানদের রক্ষার জন্য তার এই পদক্ষেপ ছিল এক নীরব বিপ্লবের সূচনা। নৈতিকতাহীন সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার মোকাবিলায় ওহীভিত্তিক নৈতিকতাসমৃদ্ধ বাস্তবমুখী শিক্ষা সংস্কারের যে সাহসী উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেছিলেন- এর সফল বাস্তবায়ন ঘটলে বিশ্বের বুকে এক আলোকিত স্বাবলম্বী বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে নিঃসন্দেহে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর আদর্শে চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক প্রকৃত আল্লাহ্ওয়ালা, সুশিক্ষিত, মানবিক গুণাবলি সমৃদ্ধ ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন সমাজ সচেতন, সৎ মানুষ এবং আদর্শ নাগরিকে পরিণত হয়েছেন।
যে মানুষটি নিয়মিত সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর জিকির ও মোরাকাবা মোশাহাদা করে; আল্লাহর ভয়ে সে কিছুতেই পাপ কাজ করতে পারে না। আর নিয়মিত জিকির-আজকার ও তা’লীম তারবিয়াতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একজন মানুষ সুশিক্ষিত ও নৈতিকতা সমৃদ্ধ হয়ে ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয় এবং সমাজমুখী হয়ে আরো দায়িত্বসচেতন হয়ে ওঠে। নিয়মিত বিশেষজ্ঞ বুজুর্গদের বই-কিতাব পাঠের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও আত্মোপলব্ধির চেতনা আরো শাণিত হয়, ব্যক্তির মাঝে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি বিকশিত হয়। আধ্যাত্মিক ক্রমোন্নতির প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং হাজারো মানুষের সংস্পর্শে ভ্রাতৃত্ববোধের পরিধি ব্যাপক রূপ লাভ করে। ব্যক্তিচিন্তা তখন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পেরিয়ে বৈশ্বিক রূপ লাভ করে। তার মোবারক হাতের প্রতিষ্ঠিত আমানত ঐতিহ্যবাহী জামেয়া রাহ্মানিয়া শুধু মা'রেফাত আর আধ্যাত্মিক মারকাজই নয়, বরং সহীহ দীন শিক্ষার বিশাল ক্যাম্পাস। এখন ঐতিহ্যবাহী কওমি মাদরাসায় হাজার হাজার আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, কারি, মুয়াল্লিম তৈরি হয়েছে, হচ্ছে, হবে ইনশাআল্লাহ্। দীনের খেদমতে তারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশ- দেশান্তরে।
মানুষের মাঝে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে,- ‘আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে মানুষ সমাজবিমুখ ও সংসার বৈরাগী হয়ে যায়’ - মহান আধ্যাত্মিক সাধক ও দার্শনিক শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. তার দর্শন-চিন্তা ও কর্মসূচির মাধ্যমে তা নতুন করে ভুল প্রমাণ করেছেন।
তিনি তার এই আদর্শিক কাফেলার বাস্তব নমুনা পেশ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, মাওলাকে পাওয়ার সাধনা মানুষকে আরো সমাজমুখী এবং পরিবার ও সংসারের প্রতি আরো দায়িত্বসচেতন করে তোলে। সন্ন্যাসপ্রবণতা আর বৈরাগ্য তো দূরের কথা বরং নিজের মাঝে রাষ্ট্রচিন্তা এবং বিশ্বচিন্তারও উন্মেষ ঘটে। বিশ্বশান্তি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেতনা বিকশিত হয়। আর্তমানবতার সেবা, সমাজ কল্যাণ ও দারিদ্র বিমোচনের উদ্দেশ্যে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. আমরা দেখতে পাই অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা, মক্তব-এর মিলনমেলা। এক কথায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মৌলিক ভিত্তিগুলো এই মহান মনীষীর মাঝে ছিল অতিমাত্রায়। মানুষ হিসেবে তিনি ভুল-ত্র“টির ঊর্ধ্বে ছিলেন, এমনটি নয়। তবে তিনি বারবার তার অনুসারী এবং ওলামায়ে কিরামের উদ্দেশ্যে বলেতেন- ‘আমার যদি কোনো ভুল হয়, আপনারা তা বলে দেবেন। এমন মহানুভবতা ও উদারতার নজির এ যুগে সত্যিই বিরল।
প্রিয় এই মানুষটি যা চেয়েছিলেন তা তিনি পুরোপুরি দেখে যেতে পারেননি। তার অনেক স্বপ্নই অপূর্ণ রয়ে গেছে। তিনি চেয়েছিলেন পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত বিশুদ্ধ মানুষ, শোষণহীন রাষ্ট্র, বৈষম্যহীন সমাজ, দারিদ্র ও নিরক্ষরতামুক্ত জাতি আর সংঘাতমুক্ত শান্তিময় বিশ্ব। এসব কিছুর জন্যেই তিনি তার জীবনকে ওয়াক্ফ করেছিলেন। অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই মহান রাব্বুল আলামিন তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন নিজের কাছে। আসলে আল্লাহ্র শানই এমন। তিনি কিছুরই পরোয়া করেন না। কাউকেই পরোয়া করেন না, যাকে খুশি নিয়ে যান। আবার যাকে খুশি পাঠিয়ে দেন।
অনুসারীরা শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-কে খুব বেশি ভালোবাসত। এদেশের লক্ষ লক্ষ-ভক্ত-অনুরক্ত ওলামায়ে কেরাম তাকে মনে-প্রাণে মহব্বত করত। তিনিও সবাইকে ভালোবাসতেন। নিজের সন্তানের মত ভালোবাসতেন। এদেশের সাধারণ মানুষও তাকে ভালোবাসত। তার সমালোচনা যারা করত, ব্যক্তি হিসেবে তারাও তাকে ভালো জানত। তার ইন্তেকালের পরই সর্বজনীন ভালোবাসার বিষয়টি বোঝা গেছে। সকলেই তার অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন, তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু যে বন্ধু তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, যার ভালোবাসার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, তিনিই যদি তাকে আরও কাছে নিতে চান, তাহলে কারই বা কী করার থাকে।
আলেমকুল শিরোমণি, উপমহাদেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ হাটহাজারি মাদ্রাসার স্বনামধন্য মহাপরিচালক হযরত শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর আমানত আল্লামা শাহ্ আহমদ শফি সাহেব, তার মৃত্যুর পর এক অভিমতে বলেছেন- ‘এ দেশের এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে শায়খুল হাদীস সাহেবের মতো একজন সাহসী মানুষের খুবই প্রয়োজন ছিল। তার মৃত্যুতে আমরা একজন বলিষ্ঠ সহকর্মী হারিয়েছি।’ তিনি আজ দুনিয়াতে নেই, তিনি কেবল স্মৃতি।   মৃত্যুর অল্প কয়েক মাস পূর্বে এক বিশেষ সাক্ষাতে তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম। দারুল উলূম দেওবন্দের মহামান্য শায়খুল হাদীস সদরুল মুদাররেসিন আল্লামা সাঈদ আহাম্মদ পালানপুরী দা.বা. হযরত শাইখুল হাদীস সাহেবকে দেখতে গিয়েছিলেন। যুগশ্রেষ্ঠ দু’জন মুহাদ্দিসের মিলনমেলায় আমরা কেবল নীরব দর্শক ছিলাম। আমি যদি জানতাম এটাই আমার জীবনের একান্ত শেষ সাক্ষাৎ হবে তাহলে আরও অনেক সময় থাকার চেষ্টা করতাম। যা হবার তা হয়ে গেছে। উলামায়ে দেওবন্দের মাসলাকের হেফাজতে তিনি নিজের জানমাল সময় ওয়াকফ করে ছিলেন।
তার মৃত্যু সংবাদ শুনার পর অসংখ্য ভক্তের পঙ্গোপালের ঢলে স্রোতের মতো আমরা জাতীয় ঈদগাহের পথে রওনা হলাম। সকাল  ১০টায় যখন সেখানে পৌঁছলাম সেখানের স্মৃতি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত স্মরণ থাকবে। লক্ষ জনতা ভক্ত আলেম ওলামাদের মাঝে নিজেকে কত অসহায় মনে হয়েছিল ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। সবই আছে, সবাই আছেন, কিন্তু একজন নেই। সারাদেশের আকাশ-বাতাস যেন শোকে মুহ্যমান ছিল। এই ভিড়ের মাঝে একবার এই প্রিয় মানুষটির কফিনে রাখা মধুমাখা চেহারা দেখে সেই দিন সত্যি নিজেকে একদিকে ব্যথাতুর অন্যদিকে ধন্য মনে করেছিলাম।
উম্মতের দরদি এই ক্ষণজন্মা মনীষীকে আল্লাহ পাক তার শান মতো বদলা দিন। তার কবরকে নূরের দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিন। তার দারজাতকে বুলন্দ করুন। আর আমাদেরকে তার জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তৌফিক দিন। আমিন ॥
তার সাথে বহুলোক আধ্যাত্মিক সম্পর্ক কায়েম করেছেন। মসনদে হাদিসে সমাসীন হয়ে আশাতীত অবদান রেখে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে উত্তম বিনিময় প্রদান করুন। জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন। আল্লাহপাক তার বর্তমান স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মাওলানা মাহ্ফুজুল হক সাহেবসহ তার সন্তানদেরকে উত্তম গুণাবলি দান করুন এবং হেফাজতে রাখুন।
হে আল্লাহ্ আপনি তার পরিবার-পরিজন ও আপনজনদের প্রতি রহম করুন। তাদের সু-স্বাস্থ্য দান করুন। উত্তম বিনিময় প্রদান করুন।
পরিশেষে আবারও হযরত শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেব রহ. -এর রেখে যাওয়া মিশনগুলোর সফলতা, পূর্ণাঙ্গতা, কামিয়াবি ও স্থায়িত্বের জন্য আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’আলার অফুরন্ত নুসরত কামনা করছি।
অতঃপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের অনুসারী সকলের প্রতি আল্লাহর রহমত নাজিল হোক। আমিন ॥
 লেখক : নির্বাহী সদস্য বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ
      

Powered by Create your own unique website with customizable templates.