১৯ রমজান ১৪৩৩ হিজরি, ৮ আগস্ট’১২ বুধবার বাংলাদেশ ও মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গভীর শোকাবহ ঘটনার জন্ম দিলো। এ দিন বেলা বারটা চল্লিশ মিনিটে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ইন্তেকাল করেন। [ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন] হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর বিদায়ে বাংলাদেশের ইসলামি অঙ্গন হারালো তার দীর্ঘ প্রায় অর্ধশতাব্দী কালের এক ও একক দিকপালকে। ইলমে হাদিসের শত-সহস্র শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন তাদের প্রিয় হাদিসের উস্তাদ। আলেম সমাজকে ছেড়ে চলে গেলেন তাদের অতুলনীয় অভিভাবক। দেশের মাদরাসাগুলো হারিয়ে ফেলল অকৃত্রিম এক দরদিবন্ধু। সর্বোপরি বাংলাদেশের ইসলামি জনতা হারালো তাদের মহান রাহবার। জামিয়া রাহমানিয়া আর রাহমানী পয়গাম তো আক্ষরিক অর্থেই এতিম হয়ে গেল। যেমনটা হয়েছে শাইখের পরিবার পরিজনের বেলায়।
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে কার্যত সমাপ্তি ঘটলো একটি ইতিহাসের। ঘটনাবহুল একটি শতাব্দীর। প্রায় শতায়ূর জীবন পাওয়া এই মহান বুযুর্গ একদিকে যেমন ছিলেন কালের স্বাক্ষী তেমনি তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর এক বিরল কর্মবীর। কাজ তো অনেকেই করেন, কিন্তু এমন চতুর্মুখী কর্মদক্ষতার সমাবেশ আর ক’জনের মধ্যেইবা ঘটে!
দুই. ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন সহাস্যবদন, সহজ সরল, উদারমন, নিরহংকারী ও মিতব্যয়ী। বিনয় ছিল তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা। সময়ানুবর্তিতা ছিল তার জীবনের সৌন্দর্য। পরনিন্দা-পরচর্চা ছিল তার একেবারেই অপছন্দ। অলসতা বলতে কোনো শব্দ তার জীবন অভিধানে পাওয়া যায় না। শিক্ষা ও দীক্ষার অপূর্ব সমন্বয়ে তিনি গঠন করে ছিলেন আত্মকে। কুরআন-হাদিস তথা ইসলামের শিক্ষাকে তিনি অপরিসীম সাধনায় আয়ত্ব করেছিলেন। ফলে ইসলামি জ্ঞানের সকল শাখায় যেমন তার দক্ষতা ছিল অসাধারণ তেমনি সমকালীন রাষ্ট্র-সমাজ ও জাতীয় আন্তর্জাতিক সকল জিজ্ঞাসার যুৎসই জবাবদানে তার পারঙ্গমতা ছিল বিস্ময়কর। শিক্ষার পাশাপাশি তিনি দীক্ষাটাও রপ্ত করেছিলেন পরিপূর্ণভাবে। আর তাই আমরা তার জীবনে দেখতে পাই এত বড় হয়েও এত বিনীত হওয়া যায়। এত কিছু করেও ‘আমি কিছুই না’ বলা যায়। ইখলাছ ও ঐকান্তিকতা তার স্বভাবে পরিণত হয়েছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
তিন. পারিবারিক জীবনে তার সাফল্যের উপমা তিনিই। কর্মব্যস্ত বড় মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের দিকে নজর দেয়ার সুযোগ পান না। কিন্তু হযরত শাইখুল হাদীস রহ. ছিলেন এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। শত ব্যস্ততার মাঝে পরিবারকে সময় দেয়া, পরিবারের প্রতিটি সন্তানকে গড়ে তোলা ছিল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’য়ালা হযরতকে অনেক সন্তান দিয়েছেন। সন্তান, সন্তানদের সন্তান এমনকি তাদের সন্তান একাধারে এই তিন প্রজন্মের দীনি তরবিয়ত ও তাদের ইলমী ও আমলী জীবন গঠনে হযরত শাইখ রহ. পালন করেছেন অনবদ্য ভূমিকা। ইন্তেকালের সময় ১৩ জন সন্তানের পাশাপাশি ১২০ জন নাতি-নাতনি রেখে গেছেন। তার ঔরষজাত এই সন্তানদের মধ্যে সত্তুরোর্ধ হাফেজে কুরআন, আরও বহু পরিমাণ অধ্যয়নরত এমনিভাবে ১৭ জন আলেম এবং তদুর্ধসংখ্যক অধ্যয়নরত রয়েছেন। জীবদ্দশায় নিজ সন্তান সন্তুতিগণকে এরূপ সুশিক্ষা ও দীনের পথে পরিচালিত করার বিষয়টি দীন ও দীনি শিক্ষার প্রতি হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর তীব্র আগ্রহ, অদম্য সংকল্প ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞার পাশাপাশি আদর্শ পরিবার গঠনে তার অনবদ্য সাফল্যের স্বাক্ষর বহন করে।
চার. ব্যক্তি ও পরিবার জীবনে এমন আদর্শ রাখার সঙ্গে সঙ্গে কর্মজীবনেও তিনি রেখেছেন অবিশ্বাস্য সব সাফল্যের স্বাক্ষর। হযরত শাইখুল হাদীস রহ. ইসলামের বহুমুখী খেদমত করেছেন অসামান্য দক্ষতার সাথে। প্রায় সাত দশক যাবত একাধারে কুরআন-হাদিস তথা ইলমেদীন শিক্ষাদানের সাথে নিজেকে নীবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছেন। এই সুদীর্ঘ সময়ে তার কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে হাজার হাজার আলেম-ওলামা ইসলাম ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে তার অগণিত ছাত্র- ভক্ত। শিক্ষকতার ক্ষেত্রে হযরত শাইখের বিশেষ সৌভাগ্য এই ছিল যে, অর্ধশতাব্দীরও অধিক কাল তিনি বিশুদ্ধতম হাদিসগ্রন্থ সহিহ বুখারি শরিফের অধ্যাপনা করেছেন। বুখারি শরিফ অধ্যাপনায় তার নিপুণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.সহ সমকালীন শীর্ষ আলেমগণ তাকে ‘শাইখুল হাদীস’ অভিধায় অভিহিত করেন।
শিক্ষক হিসেবে ছাত্রসমাজের কাছে তার যে তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল, সেও আরেক বিস্ময়কর ব্যাপার। সমকালীন সময়ে এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া কঠিন। ছাত্র গড়ার নিপুন কারিগররূপেই তিনি তার ছাত্রদের হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে থাকবেন। সুদীর্ঘ প্রায় সত্তুর বছরের শিক্ষকতার কালে তিনি বিভিন্ন সময়ে ঢাকার আশরাফুল উলূম বড়কাটারা, জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ, জামিয়া ইসলামিয়া তাঁতিবাজার, জামিয়া নূরিয়া আশরাবাদ কামরাঙ্গীরচর, জামিয়া মোহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মোহাম্মদপুর, জামিয়া শরইয়্যা মালিবাগ, জামেউল উলূম মিরপুরÑ১৪, দারুস সালাম মিরপুর, জামিয়া নূরিয়া আরিচপুর টঙ্গী, জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া, দারুস উলূম মিরপুর-১৩ জামিয়া মোহাম্মাদিয়া বনানী ও ঢাকার বাইরে বরিশাল মাহমূদিয়া মাদরাসায় বুখারি শরিফের শিক্ষাদান করেন। এ ছাড়াও খণ্ডকালীন শিক্ষকরূপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন।
অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শিক্ষাদানের পাশাপাশি প্রায় শিক্ষকতার সূচনাকাল থেকেই হযরত শাইখ রহ. লেখালেখির কাজ শুরু করেন। শিক্ষাজীবনেও তিনি বিভিন্ন পাঠ্য বিষয়ের মূল্যবান ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করেছেন। বিশেষত তার জগদ্বিখ্যাত শিক্ষক শাইখুল ইসলাম শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ. এর বুখারি শরিফের দরসের বক্তব্য পড়াকালীন সময়েই নোট করেন ও তা গ্রন্থাকারে প্রকাশের উপযুক্ত করে পাণ্ডলিপি তৈরি করেন যা প্রায় ১৮০০ পৃষ্ঠায় সুসমাপ্ত। ছাত্র জীবনে তার হাতে উর্দু ভাষায় সংকলিত এই মূল্যবান পাণ্ডুলিপি পরবর্তিতে ‘ফজলুল বারী’ নামে আংশিক প্রকাশ পেলে পাক-ভারত উপমহাদেশের আলেম সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে তা পূর্ণ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিরমিজি শরিফের একটি মূল্যবান ব্যাখ্যাগ্রন্থও তিনি ছাত্রকালে রচনা করেন। ছাত্রজীবনের লেখালেখি হয়েছে মূলত উর্দু ও আরবি ভাষায়। শিক্ষকতা শুরু করার আট-দশ বছরের মাথায়ই তার দায়িত্বে বুখারি শরিফের অধ্যাপনা সমর্পিত হয়। বুখারি শরিফ অধ্যাপনা শুরু করার পরপরই তার মনোনিবেশ হয় বাংলাভাষায় বুখারি শরিফের ভাষ্যরচনার প্রতি। এভাবেই সর্বশ্রেষ্ঠ হাদিস অনুবাদের মাধ্যমেই তার বাংলাভাষায় লেখালেখির হাতেখড়ি। একাধারে ষোল বছরের নিরলস সাধনায় সাতখণ্ডে সমাপ্ত ও পরবর্তীতে ১০ খণ্ডে বর্ধিত হয় পবিত্র বুখারি শরিফের বঙ্গানুবাদ। বুখারি শরিফের পরও তিনি লিখে গেছেন অব্যাহত গতিতে। সেই ধারায় তিনি আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ মানের কিতাব মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি রহ. এর জগদ্বিখ্যাত মসনবী শরিফের আংশিক বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ বঙ্গানুবাদ করেছেন। মুসলিম শরিফ ও অন্যান্য হাদিসের ছয় কিতাবও শাইখুল হাদীস রহ. এর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যা তিনি সূচনা করেছেন কিন্তু সমাপ্ত করতে পারেননি। এ ছাড়াও বঙ্গানুবাদ মুনাজাতে মাকবুল, ভ্রান্তির বেড়াজালে কাদিয়ানী মতবাদ, পূঁজিবাদ সমাজবাদ ও ইসলাম এবং পবিত্র কুরআনুল কারীমের নির্বাচিত সূরাসমূহের ব্যখ্যাসহ অনুবাদ তিনি করেন। এভাবেই তার হাতে রচিত হয় বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অতিব গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি অধ্যায়। বাংলাভাষায় আলেম সমাজের পশ্চাদপদতার যুগে এভাবে কলম হাতে বুকটান করে দাঁড়িয়ে যাওয়া ছিল রীতিমতো এক দুঃসাহসিক ব্যাপার। সে দুঃসাহসকে জয় করে জাতির জন্য রেখে গেছেন অনবদ্য সব উপহার। তার কাব্য প্রতিভাও ছিল বিস্ময়কর। বিশেষত নবীর প্রেম ও মদিনার আকর্ষণে আরবির উচ্চাঙ্গ ভাষায় রচিত তার শত শত কবিতা নবীপ্রেমিকদের হৃদয়ে ইশকে রাসূলের ঝড় তুলে। তার রচিত কবিতাসমগ্র ‘মদীনার টানে’ নামে প্রকশিত রয়েছে।
পাঁচ. শিক্ষকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি ইসলামি আদর্শ প্রচারে তার বাগ্মিতাও ছিল অসাধারণ। যুগের পর যুগ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে হেদায়াতের মশাল নিয়ে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন। মধ্য প্রাচ্য ও ইউরোপ আফ্রিকাসহ বহির্বিশ্বেও সফর করেছেন এ উপলক্ষে। তার হৃদয়গ্রাহী, যুক্তিপূর্ণ ও ঐকান্তিক ওয়াজ শুনে হাজারো পথহারা মানুষ পেয়েছে সত্য পথের দিশা। তার বয়ান মানুষের মনে রেখাপাত করতো। পাষানের হৃদয়ও বিগলিত হত। আবার চিন্তাশীল ও গুণীজনরা পেত তাদের চিন্তার খোরাক। হযরত শাইখের অনবদ্য কিছু বয়ান সংকলন আকারে ‘সত্যের পথে সংগ্রাম’ ও ‘সফল জীবনের পথে’ দুইখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
ছয়. অন্যান্য দায়িত্বের পাশাপাশি হযরত শাইখুল হাদীস রহ. ইমামাত ও খেতাবাতের দায়িত্বও পালন করেছেন জীবনভর। ষাট-সত্তুরের দশকে লালবাগ কেল্লা জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন। কর্মব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় এক সময় ওয়াক্তিয়ার ইমামতি বাদ দিয়ে শুধু জুমার ইমামতি পালন করেন। লালবাগ কেল্লার জামে মসজিদেই বহুদিন হযরত জুমার খুতবা দিয়েছেন। এরপর আশিরদশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আজিমপুরের কেন্দ্রীয় মসজিদ আজিমপুর এস্টেট জামে মসজিদে যা ছাপড়া মসজিদ নামে পরিচিত দীর্ঘ প্রায় পনের-বিশ বছর জুমার ইমামতি করেন। মধ্যখানে ৯৫-৯৬ সালের দিকে বেশ কিছু দিন মালিবাগ মাদরাসার প্রিন্সিপাল থাকাকালীন আজিমপুরের পাশাপাশি মালিবাগ মাদরাসা মসজিদেও জুমার ইমামতি করেন। সত্তুরের দশকের শেষ দিকে জাতীয় ঈদগাহেও ঈদের জামাতে ইমামতি করেছেন।
সাত. দীনি শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষকতার পাশাপাশি দেশসেরা একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও তিনি গড়ে তুলেছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া মোহাম্মদিয়া আরাবিয়া, যে প্রতিষ্ঠান ১৯৮৮ থেকে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া নামে পরিচালিত হয়। তার সূচারু পরিচালনায় জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া বাংলাদেশর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যিাপীঠে পরিণত হয়। শেষ জীবনে তিনি দ্বীনি ও সাধারণ শিক্ষার কার্যকর সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং সে লক্ষে ১৯৯৯ সনে জামিয়াতুল আযীয গড়ে তোলেন। জামিয়াতুল আযীয শিক্ষা ক্ষেত্রে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। ১৯৮৫-৮৬ সালে তিনি লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল ছিলেন। জামিয়া রাহমানিয়ায় এসে হযরত শাইখ রহ. ‘শাইখুল জামিয়া’ পদবী ভূষিত হন। ৯৫-৯৬ সালে মালিবাগ জামিয়া শরইয়্যাহর প্রিন্সিপাল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও সারা দেশে বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের কওমি মাদরাসা সমূহের ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষার মান উন্নয়নে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব নির্বাচিত হন।
১৯৯৯ সালে আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময়ে হযরত শাইখ রহ.-এর শরীয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং ব্যাংকের যাবতীয় কার্যকাণ্ডে শরীয়া পরিপালন কঠোরভাবে তত্ত্বাবধান করেন।
আট. ইসলামি তাহযিব-তামাদ্দুন শিক্ষা-আর্দশ প্রচারে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. একাধীক ইসলামি পত্রিকাও প্রতিষ্ঠা, সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব কালে ষাটের দশকে লালবাগ মাদরাসা থেকে তার সম্পাদনায় আল-ইসলাম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বাংলা ইসলামি সাহিত্যের দিকপালন মাওলানা মুহিউদ্দীন খানসহ সেই সময়ের তরুণ আলেদের একটি চৌকস দল নিয়ে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এ পথে অগ্রসর হন। স্বাধীনতা উত্তরকালে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া থেকে প্রথমে হক পয়গপম ও পরবর্তিতে রাহমানী পয়গাম নামক মাসিক ইসলামি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশ করেন। হযরতের জীবদ্দশায় তারই তত্ত্বাবধানে মাসিক রাহমানী পয়গামের ২০৩টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
নয়. দীন ইসলামের অনেক ময়দানে খেদমতের পাশাপাশি ইসলামি আন্দোলন ও রাজনীতির ময়দানেও তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। ছাত্র জীবনেই তিনি স্বীয় উস্তাদদের সাথে বৃটিশ বিরোধী ও পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নেন। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামি নেযাম বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় নেযামে ইসলাম পার্টির মাঠ পর্যায়ের স্বক্রিয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সারাদেশে সফরকরে ইসলামের পক্ষে জনমত গঠনে অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দেন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ূব খানের বিভিন্ন ইসলামবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে স্বীয় উস্তাদ ও মুরুব্বি মুজাহিদে আজম আল্লামা ফরিদপুরী রহ. পরিচালিত মার্শাল ল ভঙ্গ দুঃসাহসী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ওলামায়ে হক্কানীর সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে তওবার রাজনীতি নিয়ে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. খেলাফত আন্দোলন নামে ময়দানে নামলে হযরত শাইখুল হাদিস রহ. স্বীয় উস্তাদ ও পীর হযরত হাফেজ্জী হুজুরের দক্ষিণহস্তরূপে দায়িত্বপালন করেন। এই সময়ে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. হযরত হাফেজ্জীর রাজনীতির প্রধান সংগঠক, মুখপাত্র ও রূপকারের ভূমিকা রাখেন। হযরত হাফেজ্জীর সাথে ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বন্ধে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ভূমিকা রাখেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কুটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দেন।
১৯৮৭ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর ইন্তেকালের পর কার্যত হযরত শাইখুল হাদীস রহ.ই বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতি ও ধর্মীয় অঙ্গণে শীর্ষ নেতারূপে সর্বজন স্বীকৃতি লাভ করেন। এই সময়ে ১৯৮৭ সালে সমমনা দল, পীর-মাশাইখ ও ওলামাদের সমন্বয়ে ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন গঠন করেন এবং এর প্রতিষ্ঠিতা প্রথম মুখপাত্র নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর খেলাফত আন্দোলনকে একীভূত করে গঠন করেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। প্রতিষ্ঠাকালে তিনি এর অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে আমির নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে ইসলামি ছয়টি দলকে নিয়ে ইসলামপন্থীদের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক প্লাটফরম ইসলামী ঐক্যজোট গঠন করেন এবং এর সভাপতি নির্বাচিত হন। হযরত শাইখুল হাদীস রহ. নেতৃত্বে থাকা কালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলাম ও দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত যে কোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার ছিলেন। ভয়-ভীতি, লোভ-প্রলোভনকে উপেক্ষা করে সত্য-ন্যায়ের পথে সদা আপোসহীন থেকেছেন। কুখ্যাত বৃটিশ লেখক সালমান রুশদি মহানবী সা.-এর চরিত্রহনন করে তার চরম বিতর্কিত দ্যা স্যাটানিক ভার্সেস লিখলে বাংলাদেশে এর প্রতিবাদে হযরত শাইখের নেতৃত্বে ও তার ঘোষণায় নজিরবিহীন হরতাল পালন হয়। এ ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে নাস্তিক-মুরতাদদের আস্ফালন বেড়ে গেলে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জোড়ালো ভূমিকা রাখেন। বির্তকিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন, কবীর চৌধুরী ও আহমদ শরিফদের বিরুদ্ধে হরতাল পালন করেন। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভারতের উগ্রবাদি হিন্দুকর্তৃক অযোধ্যার বাবরী মসজিদ শহিদ হলে শাইখুল হাদীস রহ. এই অসভ্যতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে তোলেন এবং ১৯৯৩ সালের ৪ জানুয়ারি প্রায় ৫ লক্ষাধিক জনতার বহর নিয়ে আযোধ্যা অভিমুখে লংমার্চ করেন। বসনিয়া-হার্জেগোভেনিয়ায় চরম মুসলিম নিধন শুরু হলে শাইখুল হাদীস রহ. বাংলাদেশ থেকে বসনিয়ার মজলুম মুসলমানদের সাহায্যের জন্য মুজাহিদ সংগ্রহের অভিযান চালান।
১৯৯৬ এরপর দেশের অভ্যন্তরে শিখা চিরন্তন নামে অগ্নি পূজা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র শুরু হলে তৎকালীন রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে তিনি অকুতোভয় আন্দোলন ও জনসচেতনতা তৈরি করেন। বাংলাদেশের অভিন্ন নদীসমূহের উপর আগ্রাসী ভারতের একতরফা অন্যায় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধেও তিনি স্বোচ্চার হন। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের নিয়ন্ত্রণ ও স্বার্থ রক্ষার দাবিতে ঢাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ করেন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে চার দলীয়জোট গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন এবং জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
চার দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা থাকাকালীন বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাসমূহের প্রাণের দাবি কওমি মাদরাসা সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে নজিরবিহীন আন্দোলন গড়েন ও ত্যাগ-তিতীক্ষা স্বীকার করেন।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ইসলামের স্বপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচদফা ইসলামি আদর্শিক ধারার ওপর খেলাফত মজলিসের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ করেন। এ ছাড়াও খতমে নবুওয়ত আন্দোলন, ইসলাম বিরোধী আইন প্রতিরোধ আন্দোলন, হাইকোর্ট থেকে ফতোয়া নিষিদ্ধ করণের বিরুদ্ধে ফতোয়া আন্দোলনসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামে সর্বদা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তিন তিনবার কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। কিন্তু সঠিক পথ থেকে চুল পরিমাণও বিচ্যুত হননি। এমনি বহুমুখী কর্মতৎপরতায় সদা মুখর থেকে এক সময় বার্ধক্যের কোলে ঢলে পড়েন। বার্ধক্যজনিত কারণে জীবনের শেষ দুই বছর অবসর জীবন যাপন করে অবশেষে প্রিয় মাওলার সন্নিধ্য গ্রহণ করেন। তিনি চলেগেছেন, কিন্তু রেখেগেছেন আলোকিত এক জীনব আদর্শ। তার সে আদশের্র অনুসরণ আজ ও আগামি প্রজন্মের অনেক বেশি প্রয়োজন। আর তাই এই আলোকিত জীবনের আলোচনা ও স্মরণ খুব জরুরি। হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর মত মহান ব্যক্তির সুবিশাল জীবন ও কর্ম নিয়ে আরও গবেষণা ও পর্যলোচনা করতে হবে। তার কর্ম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক দিকগুলোর উপর ভিন্ন ভিন্ন রচনা তৈরি হতে পারে। তবে এগুলো অবশ্যই সময় সাপেক্ষ্য ও দীর্ঘ সাধণার কাজ। সময় সুযোগ করে ধীরে ধীরে ইনশাল্লাহ সে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তাৎক্ষনিক আয়োজনের মাধ্যমে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তারই প্রাণপ্রিয় মাসিক রাহমানী পয়গাম বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়ে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. সম্পর্কে কিছু কথা পাঠকের নিকট তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে। সামর্থের অভাবে স্বপ্নের মাত্রা স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি। যতটুকু হয়েছে আল্লাহর রহমতে সম্ভব হয়েছে। বিশেষ এই সংখ্যার আয়োজনে যারা ভূমিকা রেখেছেÑ তাদের শুকরিয়া আদায় করছি। বিশেষত চলমান সম্পাদনা পরিষদের সঙ্গে বিশেষ সংখ্যায় কাজ করেছেন, মাওলানা কামরুল হাসান রাহমানী, আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহসানুল হক। প্রচ্ছদশিল্পি নাজমুল হায়দার বরাবরের মতোই প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন। গদ্যশিল্পি রোকনও করেছেন সৌন্দর্য বর্ধনের কাজটা। মুদ্রণ ও প্রিন্টিং কাজে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, মাওলানা ইউনুস আনওয়ার, নজরুল ইসলাম, মাওলানা আনিসুর রহমান, মাওলানা মুনির হুসাইন। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা রইল সব লেখকদের জন্যও।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে উত্তম বদলা নসিব করুন। পাঠক আসুন আমরা সকলেই দোয়া করি আল্লাহ তা‘য়ালা হযরত শাইখুল হাদীস রহ. কে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন এবং তার অসমাপ্ত কাজগুলোকে এগিয়ে নিতে উপযুক্ত উত্তরসূরি তৈরি করে দিন। আমিন
সম্পাদক
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে কার্যত সমাপ্তি ঘটলো একটি ইতিহাসের। ঘটনাবহুল একটি শতাব্দীর। প্রায় শতায়ূর জীবন পাওয়া এই মহান বুযুর্গ একদিকে যেমন ছিলেন কালের স্বাক্ষী তেমনি তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর এক বিরল কর্মবীর। কাজ তো অনেকেই করেন, কিন্তু এমন চতুর্মুখী কর্মদক্ষতার সমাবেশ আর ক’জনের মধ্যেইবা ঘটে!
দুই. ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন সহাস্যবদন, সহজ সরল, উদারমন, নিরহংকারী ও মিতব্যয়ী। বিনয় ছিল তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা। সময়ানুবর্তিতা ছিল তার জীবনের সৌন্দর্য। পরনিন্দা-পরচর্চা ছিল তার একেবারেই অপছন্দ। অলসতা বলতে কোনো শব্দ তার জীবন অভিধানে পাওয়া যায় না। শিক্ষা ও দীক্ষার অপূর্ব সমন্বয়ে তিনি গঠন করে ছিলেন আত্মকে। কুরআন-হাদিস তথা ইসলামের শিক্ষাকে তিনি অপরিসীম সাধনায় আয়ত্ব করেছিলেন। ফলে ইসলামি জ্ঞানের সকল শাখায় যেমন তার দক্ষতা ছিল অসাধারণ তেমনি সমকালীন রাষ্ট্র-সমাজ ও জাতীয় আন্তর্জাতিক সকল জিজ্ঞাসার যুৎসই জবাবদানে তার পারঙ্গমতা ছিল বিস্ময়কর। শিক্ষার পাশাপাশি তিনি দীক্ষাটাও রপ্ত করেছিলেন পরিপূর্ণভাবে। আর তাই আমরা তার জীবনে দেখতে পাই এত বড় হয়েও এত বিনীত হওয়া যায়। এত কিছু করেও ‘আমি কিছুই না’ বলা যায়। ইখলাছ ও ঐকান্তিকতা তার স্বভাবে পরিণত হয়েছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
তিন. পারিবারিক জীবনে তার সাফল্যের উপমা তিনিই। কর্মব্যস্ত বড় মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের দিকে নজর দেয়ার সুযোগ পান না। কিন্তু হযরত শাইখুল হাদীস রহ. ছিলেন এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। শত ব্যস্ততার মাঝে পরিবারকে সময় দেয়া, পরিবারের প্রতিটি সন্তানকে গড়ে তোলা ছিল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’য়ালা হযরতকে অনেক সন্তান দিয়েছেন। সন্তান, সন্তানদের সন্তান এমনকি তাদের সন্তান একাধারে এই তিন প্রজন্মের দীনি তরবিয়ত ও তাদের ইলমী ও আমলী জীবন গঠনে হযরত শাইখ রহ. পালন করেছেন অনবদ্য ভূমিকা। ইন্তেকালের সময় ১৩ জন সন্তানের পাশাপাশি ১২০ জন নাতি-নাতনি রেখে গেছেন। তার ঔরষজাত এই সন্তানদের মধ্যে সত্তুরোর্ধ হাফেজে কুরআন, আরও বহু পরিমাণ অধ্যয়নরত এমনিভাবে ১৭ জন আলেম এবং তদুর্ধসংখ্যক অধ্যয়নরত রয়েছেন। জীবদ্দশায় নিজ সন্তান সন্তুতিগণকে এরূপ সুশিক্ষা ও দীনের পথে পরিচালিত করার বিষয়টি দীন ও দীনি শিক্ষার প্রতি হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর তীব্র আগ্রহ, অদম্য সংকল্প ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞার পাশাপাশি আদর্শ পরিবার গঠনে তার অনবদ্য সাফল্যের স্বাক্ষর বহন করে।
চার. ব্যক্তি ও পরিবার জীবনে এমন আদর্শ রাখার সঙ্গে সঙ্গে কর্মজীবনেও তিনি রেখেছেন অবিশ্বাস্য সব সাফল্যের স্বাক্ষর। হযরত শাইখুল হাদীস রহ. ইসলামের বহুমুখী খেদমত করেছেন অসামান্য দক্ষতার সাথে। প্রায় সাত দশক যাবত একাধারে কুরআন-হাদিস তথা ইলমেদীন শিক্ষাদানের সাথে নিজেকে নীবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছেন। এই সুদীর্ঘ সময়ে তার কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে হাজার হাজার আলেম-ওলামা ইসলাম ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে তার অগণিত ছাত্র- ভক্ত। শিক্ষকতার ক্ষেত্রে হযরত শাইখের বিশেষ সৌভাগ্য এই ছিল যে, অর্ধশতাব্দীরও অধিক কাল তিনি বিশুদ্ধতম হাদিসগ্রন্থ সহিহ বুখারি শরিফের অধ্যাপনা করেছেন। বুখারি শরিফ অধ্যাপনায় তার নিপুণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.সহ সমকালীন শীর্ষ আলেমগণ তাকে ‘শাইখুল হাদীস’ অভিধায় অভিহিত করেন।
শিক্ষক হিসেবে ছাত্রসমাজের কাছে তার যে তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল, সেও আরেক বিস্ময়কর ব্যাপার। সমকালীন সময়ে এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া কঠিন। ছাত্র গড়ার নিপুন কারিগররূপেই তিনি তার ছাত্রদের হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে থাকবেন। সুদীর্ঘ প্রায় সত্তুর বছরের শিক্ষকতার কালে তিনি বিভিন্ন সময়ে ঢাকার আশরাফুল উলূম বড়কাটারা, জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ, জামিয়া ইসলামিয়া তাঁতিবাজার, জামিয়া নূরিয়া আশরাবাদ কামরাঙ্গীরচর, জামিয়া মোহাম্মাদিয়া আরাবিয়া, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মোহাম্মদপুর, জামিয়া শরইয়্যা মালিবাগ, জামেউল উলূম মিরপুরÑ১৪, দারুস সালাম মিরপুর, জামিয়া নূরিয়া আরিচপুর টঙ্গী, জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া, দারুস উলূম মিরপুর-১৩ জামিয়া মোহাম্মাদিয়া বনানী ও ঢাকার বাইরে বরিশাল মাহমূদিয়া মাদরাসায় বুখারি শরিফের শিক্ষাদান করেন। এ ছাড়াও খণ্ডকালীন শিক্ষকরূপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন।
অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শিক্ষাদানের পাশাপাশি প্রায় শিক্ষকতার সূচনাকাল থেকেই হযরত শাইখ রহ. লেখালেখির কাজ শুরু করেন। শিক্ষাজীবনেও তিনি বিভিন্ন পাঠ্য বিষয়ের মূল্যবান ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করেছেন। বিশেষত তার জগদ্বিখ্যাত শিক্ষক শাইখুল ইসলাম শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ. এর বুখারি শরিফের দরসের বক্তব্য পড়াকালীন সময়েই নোট করেন ও তা গ্রন্থাকারে প্রকাশের উপযুক্ত করে পাণ্ডলিপি তৈরি করেন যা প্রায় ১৮০০ পৃষ্ঠায় সুসমাপ্ত। ছাত্র জীবনে তার হাতে উর্দু ভাষায় সংকলিত এই মূল্যবান পাণ্ডুলিপি পরবর্তিতে ‘ফজলুল বারী’ নামে আংশিক প্রকাশ পেলে পাক-ভারত উপমহাদেশের আলেম সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে তা পূর্ণ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিরমিজি শরিফের একটি মূল্যবান ব্যাখ্যাগ্রন্থও তিনি ছাত্রকালে রচনা করেন। ছাত্রজীবনের লেখালেখি হয়েছে মূলত উর্দু ও আরবি ভাষায়। শিক্ষকতা শুরু করার আট-দশ বছরের মাথায়ই তার দায়িত্বে বুখারি শরিফের অধ্যাপনা সমর্পিত হয়। বুখারি শরিফ অধ্যাপনা শুরু করার পরপরই তার মনোনিবেশ হয় বাংলাভাষায় বুখারি শরিফের ভাষ্যরচনার প্রতি। এভাবেই সর্বশ্রেষ্ঠ হাদিস অনুবাদের মাধ্যমেই তার বাংলাভাষায় লেখালেখির হাতেখড়ি। একাধারে ষোল বছরের নিরলস সাধনায় সাতখণ্ডে সমাপ্ত ও পরবর্তীতে ১০ খণ্ডে বর্ধিত হয় পবিত্র বুখারি শরিফের বঙ্গানুবাদ। বুখারি শরিফের পরও তিনি লিখে গেছেন অব্যাহত গতিতে। সেই ধারায় তিনি আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ মানের কিতাব মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি রহ. এর জগদ্বিখ্যাত মসনবী শরিফের আংশিক বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ বঙ্গানুবাদ করেছেন। মুসলিম শরিফ ও অন্যান্য হাদিসের ছয় কিতাবও শাইখুল হাদীস রহ. এর এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যা তিনি সূচনা করেছেন কিন্তু সমাপ্ত করতে পারেননি। এ ছাড়াও বঙ্গানুবাদ মুনাজাতে মাকবুল, ভ্রান্তির বেড়াজালে কাদিয়ানী মতবাদ, পূঁজিবাদ সমাজবাদ ও ইসলাম এবং পবিত্র কুরআনুল কারীমের নির্বাচিত সূরাসমূহের ব্যখ্যাসহ অনুবাদ তিনি করেন। এভাবেই তার হাতে রচিত হয় বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অতিব গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি অধ্যায়। বাংলাভাষায় আলেম সমাজের পশ্চাদপদতার যুগে এভাবে কলম হাতে বুকটান করে দাঁড়িয়ে যাওয়া ছিল রীতিমতো এক দুঃসাহসিক ব্যাপার। সে দুঃসাহসকে জয় করে জাতির জন্য রেখে গেছেন অনবদ্য সব উপহার। তার কাব্য প্রতিভাও ছিল বিস্ময়কর। বিশেষত নবীর প্রেম ও মদিনার আকর্ষণে আরবির উচ্চাঙ্গ ভাষায় রচিত তার শত শত কবিতা নবীপ্রেমিকদের হৃদয়ে ইশকে রাসূলের ঝড় তুলে। তার রচিত কবিতাসমগ্র ‘মদীনার টানে’ নামে প্রকশিত রয়েছে।
পাঁচ. শিক্ষকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি ইসলামি আদর্শ প্রচারে তার বাগ্মিতাও ছিল অসাধারণ। যুগের পর যুগ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে হেদায়াতের মশাল নিয়ে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন। মধ্য প্রাচ্য ও ইউরোপ আফ্রিকাসহ বহির্বিশ্বেও সফর করেছেন এ উপলক্ষে। তার হৃদয়গ্রাহী, যুক্তিপূর্ণ ও ঐকান্তিক ওয়াজ শুনে হাজারো পথহারা মানুষ পেয়েছে সত্য পথের দিশা। তার বয়ান মানুষের মনে রেখাপাত করতো। পাষানের হৃদয়ও বিগলিত হত। আবার চিন্তাশীল ও গুণীজনরা পেত তাদের চিন্তার খোরাক। হযরত শাইখের অনবদ্য কিছু বয়ান সংকলন আকারে ‘সত্যের পথে সংগ্রাম’ ও ‘সফল জীবনের পথে’ দুইখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
ছয়. অন্যান্য দায়িত্বের পাশাপাশি হযরত শাইখুল হাদীস রহ. ইমামাত ও খেতাবাতের দায়িত্বও পালন করেছেন জীবনভর। ষাট-সত্তুরের দশকে লালবাগ কেল্লা জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন। কর্মব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় এক সময় ওয়াক্তিয়ার ইমামতি বাদ দিয়ে শুধু জুমার ইমামতি পালন করেন। লালবাগ কেল্লার জামে মসজিদেই বহুদিন হযরত জুমার খুতবা দিয়েছেন। এরপর আশিরদশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আজিমপুরের কেন্দ্রীয় মসজিদ আজিমপুর এস্টেট জামে মসজিদে যা ছাপড়া মসজিদ নামে পরিচিত দীর্ঘ প্রায় পনের-বিশ বছর জুমার ইমামতি করেন। মধ্যখানে ৯৫-৯৬ সালের দিকে বেশ কিছু দিন মালিবাগ মাদরাসার প্রিন্সিপাল থাকাকালীন আজিমপুরের পাশাপাশি মালিবাগ মাদরাসা মসজিদেও জুমার ইমামতি করেন। সত্তুরের দশকের শেষ দিকে জাতীয় ঈদগাহেও ঈদের জামাতে ইমামতি করেছেন।
সাত. দীনি শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষকতার পাশাপাশি দেশসেরা একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও তিনি গড়ে তুলেছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া মোহাম্মদিয়া আরাবিয়া, যে প্রতিষ্ঠান ১৯৮৮ থেকে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া নামে পরিচালিত হয়। তার সূচারু পরিচালনায় জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া বাংলাদেশর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যিাপীঠে পরিণত হয়। শেষ জীবনে তিনি দ্বীনি ও সাধারণ শিক্ষার কার্যকর সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং সে লক্ষে ১৯৯৯ সনে জামিয়াতুল আযীয গড়ে তোলেন। জামিয়াতুল আযীয শিক্ষা ক্ষেত্রে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। ১৯৮৫-৮৬ সালে তিনি লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল ছিলেন। জামিয়া রাহমানিয়ায় এসে হযরত শাইখ রহ. ‘শাইখুল জামিয়া’ পদবী ভূষিত হন। ৯৫-৯৬ সালে মালিবাগ জামিয়া শরইয়্যাহর প্রিন্সিপাল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও সারা দেশে বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের কওমি মাদরাসা সমূহের ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষার মান উন্নয়নে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব নির্বাচিত হন।
১৯৯৯ সালে আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময়ে হযরত শাইখ রহ.-এর শরীয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং ব্যাংকের যাবতীয় কার্যকাণ্ডে শরীয়া পরিপালন কঠোরভাবে তত্ত্বাবধান করেন।
আট. ইসলামি তাহযিব-তামাদ্দুন শিক্ষা-আর্দশ প্রচারে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. একাধীক ইসলামি পত্রিকাও প্রতিষ্ঠা, সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব কালে ষাটের দশকে লালবাগ মাদরাসা থেকে তার সম্পাদনায় আল-ইসলাম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বাংলা ইসলামি সাহিত্যের দিকপালন মাওলানা মুহিউদ্দীন খানসহ সেই সময়ের তরুণ আলেদের একটি চৌকস দল নিয়ে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এ পথে অগ্রসর হন। স্বাধীনতা উত্তরকালে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া থেকে প্রথমে হক পয়গপম ও পরবর্তিতে রাহমানী পয়গাম নামক মাসিক ইসলামি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশ করেন। হযরতের জীবদ্দশায় তারই তত্ত্বাবধানে মাসিক রাহমানী পয়গামের ২০৩টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
নয়. দীন ইসলামের অনেক ময়দানে খেদমতের পাশাপাশি ইসলামি আন্দোলন ও রাজনীতির ময়দানেও তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। ছাত্র জীবনেই তিনি স্বীয় উস্তাদদের সাথে বৃটিশ বিরোধী ও পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নেন। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামি নেযাম বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় নেযামে ইসলাম পার্টির মাঠ পর্যায়ের স্বক্রিয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সারাদেশে সফরকরে ইসলামের পক্ষে জনমত গঠনে অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দেন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ূব খানের বিভিন্ন ইসলামবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে স্বীয় উস্তাদ ও মুরুব্বি মুজাহিদে আজম আল্লামা ফরিদপুরী রহ. পরিচালিত মার্শাল ল ভঙ্গ দুঃসাহসী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ওলামায়ে হক্কানীর সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে তওবার রাজনীতি নিয়ে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. খেলাফত আন্দোলন নামে ময়দানে নামলে হযরত শাইখুল হাদিস রহ. স্বীয় উস্তাদ ও পীর হযরত হাফেজ্জী হুজুরের দক্ষিণহস্তরূপে দায়িত্বপালন করেন। এই সময়ে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. হযরত হাফেজ্জীর রাজনীতির প্রধান সংগঠক, মুখপাত্র ও রূপকারের ভূমিকা রাখেন। হযরত হাফেজ্জীর সাথে ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বন্ধে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ভূমিকা রাখেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কুটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দেন।
১৯৮৭ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর ইন্তেকালের পর কার্যত হযরত শাইখুল হাদীস রহ.ই বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতি ও ধর্মীয় অঙ্গণে শীর্ষ নেতারূপে সর্বজন স্বীকৃতি লাভ করেন। এই সময়ে ১৯৮৭ সালে সমমনা দল, পীর-মাশাইখ ও ওলামাদের সমন্বয়ে ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন গঠন করেন এবং এর প্রতিষ্ঠিতা প্রথম মুখপাত্র নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর খেলাফত আন্দোলনকে একীভূত করে গঠন করেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। প্রতিষ্ঠাকালে তিনি এর অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে আমির নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে ইসলামি ছয়টি দলকে নিয়ে ইসলামপন্থীদের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক প্লাটফরম ইসলামী ঐক্যজোট গঠন করেন এবং এর সভাপতি নির্বাচিত হন। হযরত শাইখুল হাদীস রহ. নেতৃত্বে থাকা কালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলাম ও দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত যে কোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বোচ্চার ছিলেন। ভয়-ভীতি, লোভ-প্রলোভনকে উপেক্ষা করে সত্য-ন্যায়ের পথে সদা আপোসহীন থেকেছেন। কুখ্যাত বৃটিশ লেখক সালমান রুশদি মহানবী সা.-এর চরিত্রহনন করে তার চরম বিতর্কিত দ্যা স্যাটানিক ভার্সেস লিখলে বাংলাদেশে এর প্রতিবাদে হযরত শাইখের নেতৃত্বে ও তার ঘোষণায় নজিরবিহীন হরতাল পালন হয়। এ ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে নাস্তিক-মুরতাদদের আস্ফালন বেড়ে গেলে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জোড়ালো ভূমিকা রাখেন। বির্তকিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন, কবীর চৌধুরী ও আহমদ শরিফদের বিরুদ্ধে হরতাল পালন করেন। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভারতের উগ্রবাদি হিন্দুকর্তৃক অযোধ্যার বাবরী মসজিদ শহিদ হলে শাইখুল হাদীস রহ. এই অসভ্যতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে তোলেন এবং ১৯৯৩ সালের ৪ জানুয়ারি প্রায় ৫ লক্ষাধিক জনতার বহর নিয়ে আযোধ্যা অভিমুখে লংমার্চ করেন। বসনিয়া-হার্জেগোভেনিয়ায় চরম মুসলিম নিধন শুরু হলে শাইখুল হাদীস রহ. বাংলাদেশ থেকে বসনিয়ার মজলুম মুসলমানদের সাহায্যের জন্য মুজাহিদ সংগ্রহের অভিযান চালান।
১৯৯৬ এরপর দেশের অভ্যন্তরে শিখা চিরন্তন নামে অগ্নি পূজা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র শুরু হলে তৎকালীন রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে তিনি অকুতোভয় আন্দোলন ও জনসচেতনতা তৈরি করেন। বাংলাদেশের অভিন্ন নদীসমূহের উপর আগ্রাসী ভারতের একতরফা অন্যায় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধেও তিনি স্বোচ্চার হন। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের নিয়ন্ত্রণ ও স্বার্থ রক্ষার দাবিতে ঢাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ করেন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে চার দলীয়জোট গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন এবং জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
চার দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা থাকাকালীন বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাসমূহের প্রাণের দাবি কওমি মাদরাসা সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে নজিরবিহীন আন্দোলন গড়েন ও ত্যাগ-তিতীক্ষা স্বীকার করেন।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ইসলামের স্বপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচদফা ইসলামি আদর্শিক ধারার ওপর খেলাফত মজলিসের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ করেন। এ ছাড়াও খতমে নবুওয়ত আন্দোলন, ইসলাম বিরোধী আইন প্রতিরোধ আন্দোলন, হাইকোর্ট থেকে ফতোয়া নিষিদ্ধ করণের বিরুদ্ধে ফতোয়া আন্দোলনসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামে সর্বদা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তিন তিনবার কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। কিন্তু সঠিক পথ থেকে চুল পরিমাণও বিচ্যুত হননি। এমনি বহুমুখী কর্মতৎপরতায় সদা মুখর থেকে এক সময় বার্ধক্যের কোলে ঢলে পড়েন। বার্ধক্যজনিত কারণে জীবনের শেষ দুই বছর অবসর জীবন যাপন করে অবশেষে প্রিয় মাওলার সন্নিধ্য গ্রহণ করেন। তিনি চলেগেছেন, কিন্তু রেখেগেছেন আলোকিত এক জীনব আদর্শ। তার সে আদশের্র অনুসরণ আজ ও আগামি প্রজন্মের অনেক বেশি প্রয়োজন। আর তাই এই আলোকিত জীবনের আলোচনা ও স্মরণ খুব জরুরি। হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর মত মহান ব্যক্তির সুবিশাল জীবন ও কর্ম নিয়ে আরও গবেষণা ও পর্যলোচনা করতে হবে। তার কর্ম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক দিকগুলোর উপর ভিন্ন ভিন্ন রচনা তৈরি হতে পারে। তবে এগুলো অবশ্যই সময় সাপেক্ষ্য ও দীর্ঘ সাধণার কাজ। সময় সুযোগ করে ধীরে ধীরে ইনশাল্লাহ সে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তাৎক্ষনিক আয়োজনের মাধ্যমে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তারই প্রাণপ্রিয় মাসিক রাহমানী পয়গাম বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়ে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. সম্পর্কে কিছু কথা পাঠকের নিকট তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে। সামর্থের অভাবে স্বপ্নের মাত্রা স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি। যতটুকু হয়েছে আল্লাহর রহমতে সম্ভব হয়েছে। বিশেষ এই সংখ্যার আয়োজনে যারা ভূমিকা রেখেছেÑ তাদের শুকরিয়া আদায় করছি। বিশেষত চলমান সম্পাদনা পরিষদের সঙ্গে বিশেষ সংখ্যায় কাজ করেছেন, মাওলানা কামরুল হাসান রাহমানী, আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহসানুল হক। প্রচ্ছদশিল্পি নাজমুল হায়দার বরাবরের মতোই প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন। গদ্যশিল্পি রোকনও করেছেন সৌন্দর্য বর্ধনের কাজটা। মুদ্রণ ও প্রিন্টিং কাজে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, মাওলানা ইউনুস আনওয়ার, নজরুল ইসলাম, মাওলানা আনিসুর রহমান, মাওলানা মুনির হুসাইন। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা রইল সব লেখকদের জন্যও।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে উত্তম বদলা নসিব করুন। পাঠক আসুন আমরা সকলেই দোয়া করি আল্লাহ তা‘য়ালা হযরত শাইখুল হাদীস রহ. কে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন এবং তার অসমাপ্ত কাজগুলোকে এগিয়ে নিতে উপযুক্ত উত্তরসূরি তৈরি করে দিন। আমিন
সম্পাদক