- গাজী মোহাম্মাদ সানাউল্লাহ
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। এ নামটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে আমাদের হদয়ের দৃশ্যপটে যার পবিত্র মুখাবয়ব প্রতিভাত হয়ে উঠে তাঁর পরিচয় কেবল একবাক্যে দেয়া সম্ভব নয়। তিনি যেমনি ছিলেন একাধারে হাদিসেরাসুলের কিংবদন্তিপুরুষ, তেমনি ইলমেদীনের দেদিপ্যমান এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি যেমনি সকলের প্রিয়, আপন ও আন্তরিক অভিভাবক ছিলেন, তেমনি ছিলেন বাতিলের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা আল্লাহর খোলা তরবারী। শাইখুল হাদীস একটি নাম, একটি ইতিহাস, যুগ-জমানার আন্দোলন- সংগ্রামমুখর একটি আলোচিত অধ্যায়। শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ছিলেন উম্মাহ’র এই ক্রান্তিকালীন সময়ের এক অনন্য দিকপাল। কালের বিবর্তনে শতবছরের অবদান
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর জীবনে আমরা বহুমাত্রিক প্রতিভার অনন্য বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। তিনি ছিলেন একাধারে হাদিসেরাসুলের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর, বিদগ্ধ অনুবাদক, প্রথিতযশা লেখক ও সাহিত্যিক, আরবিসাহিত্যের উচ্চমান কবি, সফল সংগঠক ও নির্মোহ রাজনীতিবিদ। এমন বহুমাত্রিক গুণ ও যোগ্যতার সমন্বয় একজন মানুষের মাঝে সাধারণত পাওয়া যায় না। সবকিছু ছাপিয়ে তার বড়ো পরিচয় ছিলো তিনি জমিনের মানুষের যতোটা প্রিয়, তারচে অনেক বেশি প্রিয় ও মকবুল আকাশের মহান মনিবের। তাই তো তার সমগ্র জীবনের পরতে পরতে আমরা খুঁজে পাই আল্লাহর আনুগত্য, রাসুলের অনুসরণ আর উম্মাহর আগামীদিনের পাথেয়। শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ছিলেন পরশপাথরতুল্য এক মহামানব। তার পুণ্যপরশে যারাই এসেছেন তারাই পরিণত হয়েছেন এক একটি আলোকবর্তিকায়। এ কথা ধ্র“বসত্য, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. সম্পর্কে যতো বলা হবে, যতো লেখা হবে, ততোই তাঁর বরকতময় জীবন ও কর্ম সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পাবে। আরো সমুজ্জ্বল হবে আমাদের আগামীদিনের পথ ও পাথেয়।
একজন মানুষ যখন চোখের সামনে থাকেন, হাটেন, কথা বলেন, মাদরাসায় যান, বাসায় ফেরেন, তখন তাকে নিয়ে, তার জীবনের গল্প নিয়ে, তার বর্নাঢ্য কর্মতৎপরতারচিত্র নিয়ে লেখা যতটা সহজ, সে মানুষটি যখন পৃথিবী থেকে চলে যান না ফেরার দেশে, তখন তার বিষয়ে লেখাটা কিন্তু ততটা সহজ নয়। মানুষ যখন বেচে থাকে তখন তাকে চোখের পর্দায় চিত্রিত করে তার জীবনচরিতের ফ্রেম অংকন করা যায়,এ কারনেই বোধকরি চিত্রকর যখন গাছগাছালি বা পরিবেশ-প্রকৃতির ছবি আকেন, তখন ছবিটির নিখুত চিত্রায়নের জন্য সে বস্তুটি সামনে নিয়ে আকেন, কিন্তু যখন তিনি পৃথিবী থেকে চলে যান তখন তার ছবি আকতে হয় মনের পর্দায়, যে পর্দা দেখা যায়না, কেবল অনুধাবন করা যায়। অনুভূতির নিগুঢ়তা যত বেশি হবে, সে ছবি তত সুন্দর হবে।
শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রাহ. কে নিয়ে এর আগেও লিখেছি,তার জীবনের নানা অংশ এই অযোগ্য হাতে কাগজের পাতায় তুলে ধরার আপ্রান চেষ্ঠা করেছি। যখন লিখেছি, তখন হয়ত তিনি তার প্রিয়তম প্রতিষ্ঠান জামিয়া রাহমানিয়ায়। ২য় তলার একেবারে শেষ প্রান্তের নির্জন কোলাহল মুক্ত নিবিঢ় কক্ষটিতে বসে আছেন। সাদা সুতি কাপড়ের ফতোয়া গায়ে। তার ছোট্র টেবিলটিতে কিছুটা উবু হয়ে বসে বুখারী শরিফ অনুবাদের সম্পাদনা করছেন। অথবা তিনি অবস্থান করছেন ইতিহাস স্পর্শিত ৭/ ২ আজিমপুরের বাড়িতে । তাকে ঘিরে রেখেছ অন্তরে মহান আল্লাহর পাক কোরআন ধারনকারী একঝাক বেহেস্তি শিশু-কিশুর। নিস্পাপ কচিকন্ঠে চারপাশে কলরব উঠেছে- দাদজানের আগমন,শুভেচ্ছা স্বাগতম।
কিন্তু আজ যখন এ লেখা লিখছি তখন তিনি এ দু জায়গা থেকে অনেক দুরে। তার প্রিয়তম প্রতিষ্ঠান জামিয়া রাহমানিয়ার অদুরে আটিবাজারের ঘাটারচরের সবুজ যমিনে। শান্ত, নিবিড়, প্রকৃতির এক সবুজাভ পরিবেশ । তিনি ঘুমিয়ে আছেন শান্তিতে, প্রশান্তিতে । আর মহান করুনাময় আল্লাহ পাকের পরম মমতায়।
জীবনের কোন সে লগ্নে এসে শায়েখকে দেখে আমার এ চোখ প্রথম ধন্য হয়েছে তা দিন তারিখ দিয়ে বলা যাবে না। তবে এতটুকু হলফ করে বলতে পারি বুঝ হওয়ার পর থেকেই পবিত্র ও প্রভাবময় ‘ শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ’ এই নামটির সাথে পরিচিত হই। ছাত্র সময়ের নানা প্রান্ত পেরিয়ে ২০০৪ সালে ভর্তি হই জীবনের স্বপ্নময় প্রতিষ্ঠান জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ায়। এরও এক বছর পরে ধীরে ধীরে শায়খের খেদমতে যাওয়া সুযোগ হয়। কখনো গাড়ি থেকে তাকে ধরে নামানো, কখনো বা হুইল চেয়ারে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আবার কখনোও আছরের নামাজের পরে শায়খ যখন জামিয়া রহমানিয়ার দ্বিতীয় তলায় মাসিক রহমানী পায়গাম অফিসের সামনে বসে থাকতেন, সে সময় তার মাথায় তেল দেওয়ার সুভাগ্য অনেক সময়ই অর্জন হত। তারপর ধীরে ধীরে সেই মহান কিংবদন্তির আরো নৈকাট্য লাভের সুযোগ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন দিলেন। একটা সময় শায়খের খেদমতে নিয়মিত হয়ে গেলাম। তার আরো কিছুদিন পর সম্পৃক্ত হলাম শায়খের ভালোবাসার পত্রিকায় মাসিক রাহমানিয়ায় পয়গামের সাথে। সেই ২০০৪ থেকে ২০১২ এর আগষ্ট । ক্যালেন্ডারের পাতায় খুব বেশি দিন না হলেও আমার জীবনে একটুই ছিল স্বর্ণসময়। এসময় জীবনে আর আসবে না । আমার জীবনের বিগত এই ৯ বছরে নানা ভাবে একেবারে কাছ থেকে শায়খকে দেখার সুযোগ হয়েছে। ঘরে বাইরে, মাঠে-ময়দানে, ওয়াজ-মাহফিলে। এর জন্য সে মহামহিমের কাছে অসংখ্য শোকরিয়া । যিনিই কেবল সবকিছুর তাওফিকদাতা ।
সাধারণত শায়খ জামিয়া রাহমানিয়াতেই বেশিভাগ সময় অবস্থান করতেন। বাসায় খুব বেশি একটা সময় থাকতেন না। কখনোও যদি মাহফিল থাকতো অথবা রাজনৈতিক কোনো প্রোগ্রাম। সেক্ষেত্রেও তিনি মাদরাসা থেইে সেখানে যেতেন। তবে সপ্তাহের যেকোনো একটা দিন নিয়ম করে তিনি বাসায় যেতেন। যত ব্যস্ততাই হোক পরিবারকে গুরুত্ব সহকারে একটা সময় তিনি দিতেন। জীবনের পরন্ত বেলায় এসেও পরিবারের পতি সন্তানাদির প্রতি শায়খ অনেক দায়িত্বশীল ছিলেন।
শায়েখ যেদিন বাসায় যেতেন আগে থেকেই এর প্রস্তুতি শুরু হতো। শায়খের রুমে টেবিলের বাম পাশে একটি টেলিফোন সেট আছে। সেটা থেকেই শায়খ বাসায় কথা বলতেন। শায়খের বাসাতেও টিএন্ডটি লাইন। পরিবারের সাথে শায়খের দূরালাপন টেলিফোনের মাধ্যমেই হতো। বাসায় আগে ফোন করে বলে দিতেন আমি আজ বাসায় আসবো। আমাদেরকে কাউকে ডেকে বলতেন, আমি অমুক সময় বাসায় যাবো। ড্রাইভারকে বলে রেখো। মাদরাসা শায়খের সাথে দেখা করতে নানা প্রান্তের মানুষজন আসতো। শায়খের প্রতি আপ্রাণ ভক্তকুল নানা সময় বিভিন্ন ফল-ফলাদি নিয়ে আসতেন। এসব জিনিস রাখার হতো শায়খের ছোট ফ্রিজটিতে। প্রতিবেলায় খাবারের পরে শায়েখ ফল খেতেন। শায়খ যেদিন বাসায় যাবেন সেদিন নিজেই ফ্রিজ থেকে কিছু ফল কখনো বা মিষ্টি বা দই যাই থাকতো তা বাসার জন্য নিয়ে যেতেন।
বাসায় যাওয়ার পরে দৃশ্যটা আরো চমৎকার। শায়খের বাসায় একটি অনন্য সুন্দর্য্য হলো তার আওলাদ। আওলাদ বলতে আমি এখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের কথা বুঝাতে চাচ্ছি। নাতি-পুতি সব মিলিয়ে শায়খ পরিবারের হাফেজের সংখ্যা ৭০ এর উপরে। শায়খ যখন বাসায় যেতেন, তখন এক ঝাক নাতি-পুতি শায়খকে স্বাগত জানাতো। এটা কোনো আনুষ্ঠানিক ভাবে নয়। শায়খ যখন বাসায় উপস্থিত হতেন, তখন বাসার ভেতর থেকে ছোট ছোট বাচ্চারা নেমে আসতো। দাদা-এসেছে দাদা এসেছে কচিকণ্ঠের এই স্লোগানের প্রথম থেকে দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত মুখরিত হয়ে উঠতো। শায়খ মুখে কিছুটা হাসি ঝুলিয়ে একটি দমক দিতেন। ঐ তোরা ভেতরা যা, দেখছো পলাপানের কারবার। শায়খ সব সময় বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। এ ভাষা শায়খের মুখে এতো চমৎকার লাগতো তা বলে বুঝানো যাবে না।
শায়খের একটি বাধাধরা নিয়ম ছিল তিনি সাধারণত বাসা অথবা মাদরাসার বাইরে রাত্রি যাপন করতেন না। অনেক সময় এরকম হয়েছে, আজ সিলেটে মাহফিল। কাল মৌলভীবাজারে। শায়খ কিন্তু রাতে ঠিকই ঢাকা চলে আসবেন। রাতে মাদরাসায় থেকে পরদিন ঢাকার একাধিক মাদরাসার পড়িয়ে এরপর তিনি আবার মৌলভীবাজের উদ্দেশ্যে রওনা করতেন। এর অনেকটা কারণ ছিল ছাত্রদের প্রতি শায়খের দায়িত্বশীলতা। প্রোগ্রাম শেষ করে যত রাতেই তিনি ঢাকা ফিরেন না কেন পর দিন সকালে বাদ ফজর অবশ্যই বুখারীর দরস দিতেন। কোন ক্লান্তি নেই। কোন বিরুক্তি নেই।
।
লেখক: সম্পাদক.ইসলামবার্তা ডটকম